কৃষি যান্ত্রিকীকরণ

প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সক্রিয় হোক কৃষি মন্ত্রণালয়

কৃষির পরবর্তী রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যান্ত্রিকীকরণ। অনেক দিন ধরে বিভিন্ন মহলে এটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সর্বশেষ গত সোমবারও রাজধানীতে যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচ্য কর্মশালায় কৃষির আধুনিকায়ন যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোরারোপ করেছেন বক্তারা। যথার্থ কারণে গত কয়েক বছর থেকে সরকারও এর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তথ্য বলছে, অঞ্চলভেদে বর্তমানে ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষিযন্ত্র দেয়া হচ্ছে। কৃষিতে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে প্রযুক্তি যন্ত্রের ব্যবহার, অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গতি এখনো মন্থর। আমাদের প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ বদলাতে হলে যান্ত্রিকীকরণ বেগবান করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা প্রচেষ্টা আরো বাড়াতে হবে বৈকি।

শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাবে কয়েক দশক ধরে মানুষ শহরমুখী। ফলে ক্রমেই কমছে কৃষিকাজের লোক। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে ফসলের মৌসুমে শ্রম ঘাটতি কৃষি খাতে একটি বড় ইস্যু হিসেবে হাজির হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতাও দিন দিন বেড়ে চলছে। প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া কৃষির আগামীর লক্ষ্য অর্জন কঠিন। কাজেই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ জোরদারের বিকল্প নেই। তবে বাস্তবতা হলো, যান্ত্রিকীকরণ প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় জমির আয়তন। আমাদের দেশে বড় কৃষকের সংখ্যা কমছে। বর্তমানে চাষাবাদ করছেন মূলত প্রান্তিক কৃষকরা। তাদের জমিগুলো ছোট। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রজন্মান্তরে সেগুলো আরো ছোট হচ্ছে। এছাড়া কারো জমিতে ফসল আগে আসে, কারো আসে পরে। অবস্থায় একজনের জমি মাড়িয়ে অন্যের জমিতে কৃষিযন্ত্র আনা-নেয়া সম্ভব নয়। কৃষিযন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম প্রতিবন্ধক। আছে কৃষিযন্ত্রের দামের প্রশ্নও। বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্রে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানা যাচ্ছে। এসব উদ্যোগের পরও কৃষিযন্ত্র কেনা প্রান্তিক কৃষকের জন্য সহজ নয়। কেননা নানা দেনায় তারা আগে থেকেই জর্জরিত। ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না তারা। হাতে নেই বাড়তি পুঁজি। আবার ভর্তুকি মূল্যে বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিনলেও কোথায় রাখবেন, কীভাবে চালাবেন, কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন, তার জ্ঞান নেই; নেই -সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। এসব কারণে তারা কৃষিযন্ত্র কেনা ব্যবহারে খুব একটা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন না। সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটাতে হলে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিতপূর্বক এর সুষ্ঠু সমাধান জরুরি।

অর্থনৈতিক নবতর রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কমে আসে। এটি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানে জাপান, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র সুইডেনে মাত্র - শতাংশ লোক কৃষির সঙ্গে যুক্ত। যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্পসংখ্যক লোক দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য উৎপাদন করছে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য আবার রফতানিও করা হচ্ছে। ওইসব দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে বৃহৎ বাণিজ্যিক কৃষি, যৌথ খামার কিংবা কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিংয়ের কারণে। সুতরাং এখানে যান্ত্রিকীকরণের ব্যাপকতর বিস্তার করতে হলে সামগ্রিক ভূমি সংস্কার প্রয়োজন। উল্লিখিত দেশগুলো এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা, নীতি, কৌশল পর্যালোচনা করে এক্ষেত্রে কার্যকর উপায় সন্ধান পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।

খবর মিলছে, ভূমি মালিকানা আইল বজায় রেখে আধুনিক চাষাবাদের এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা। এর নাম দেয়া হয়েছে সমলয় আবাদ পদ্ধতি। নতুন পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে ফসল কাটা, সবই এক সময়ে একযোগে করা হবে। স্বল্প মানুষের সাহায্যে কাজটা করবে যন্ত্র। পদ্ধতির পাইলটিং চলছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এটি হতে পারে একটি যুগান্তকারী উপায়। তেমনটি হলে বড় সংস্কার ছাড়াই আপাতত কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে বৈকি। কাজেই সুফল নিরীক্ষা করে এর প্রসার ঘটানো দরকার। অনেকেই বলছে, একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে বড় কৃষিযন্ত্র কেনাটা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। সেক্ষেত্রে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ বা সমিতির মাধ্যমে কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। কিন্তু এক্ষেত্রে মালিকানা প্রশ্নটি জটিলতা তৈরি করছে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানা ছাড়া গোষ্ঠীভিত্তিক বা সমিতির নামে কৃষিযন্ত্র কেনার সুযোগ নেই। -সম্পর্কিত বিধিবিধানে পরিবর্তন আনা না হলে যৌথভাবে কেনা সম্ভব নয় কিংবা মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। এর সমাধান জরুরি। ভারতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তরফ থেকে কৃষিযন্ত্র কেনা হয়। একটি ন্যূনতম ফি দিয়ে কৃষক তা ব্যবহার করেন। সংরক্ষণ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ, সার্ভিসিং সবই করে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। কৃষকের জন্য এটি আর্থিকভাবে টেকসই। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রসারের ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা আমলে নেয়া যেতে পারে।

বিশ্বজুড়ে যে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে যান্ত্রিকীকরণ। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে রোবট, ড্রোন, সেন্সর কৃত্রিম বুদ্ধিচালিত যন্ত্রের ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বৈশ্বিক রূপান্তরের ধারা আমাদের দেশেও বহমান। চূড়ান্তভাবে আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে। তাই কৃষিতে ব্যয় কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কেবল যন্ত্র ব্যবহারের বিষয় নয়; এর সঙ্গে অনেক কিছু যুক্ত। যন্ত্র বিকল হলে তা মেরামতে সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে তোলা, খুচরো যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত, রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত, দক্ষ জনবল তৈরির মতো দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। কৃষি প্রকৌশলগত বিদ্যার সম্প্রসারণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে দেশীয় সক্ষমতা বাড়াতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেয়া চাই।

ক্রমসংকুচিত কৃষিজমির প্রেক্ষাপটে এক সময় কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমে আসবে। তখন খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। সংকট উত্তরণে কৃষি যান্ত্রিকীকরণই সই। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়ে, খাদ্যনিরাপত্তা টেকসই হয়। বৈশ্বিকভাবে এটি প্রমাণিত। তাই আগে-পরে আমাদেরও খামারভিত্তিক লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষি গড়ে তুলতে হবে, কৃষিযন্ত্র প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। কাজটি বেগবান করতে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা আরো বাড়বে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন