সালটি ছিল ১৯৯৯।
বহু দশকের অব্যবস্থাপনা এবং সামরিক শাসনের অধীনে লুণ্ঠনের পরে নাইজেরিয়ায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছিল।
গণতন্ত্রের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটির অর্থনীতি।
হাজার হাজার নাইজেরিয়ান অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে দেশকে সহায়তা করতে এসেছিল।
তবে সেই অগ্রযাত্রা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভুল পদক্ষেপে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশটির অর্থনীতি।
বর্তমানে কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব আফ্রিকার বৃহত্তম এ অর্থনীতিকে ধসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে।
আর এটা পুরো আফ্রিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হতে পারে।
খবর ব্লুমবার্গ।
বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেলের রিজার্ভ, বিশাল আবাদযোগ্য জমি এবং আফ্রিকান সংগীত ও ফ্যাশনের প্রবণতা নির্ধারণকারী ২০ কোটি ৬০ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী নাইজেরিয়ার বৈশ্বিক প্লাটফর্মে জায়গা করে নেয়ার সম্ভবনা ছিল।
পরিবর্তে ভুল নীতি, ব্যাপক দুর্নীতি এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ওপর অতিনির্ভরতা দেশটির অর্থনীতিতে ভয়াবহতার সৃষ্টি করেছে।
এমনিতেই আফ্রিকা মহাদেশ বিশ্বের বাকি অঞ্চল থেকে দ্রুত পিছিয়ে পড়ছে।
এর সঙ্গে নাইজেরিয়ার জাতিগত উত্তেজনা, যুবসমাজের অসন্তুষ্টি ও অপরাধ প্রবণতার হুমকি পুরো অঞ্চলে আরো দারিদ্র্য ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
১৯৫০-এর দশকে দক্ষিণপূর্ব উপকূলের ম্যানগ্রোভ বনের নিচে আবিষ্কার হওয়ার পর জ্বালানি তেল নাইজেরিয়ার অর্থনীতিকে চক্রের মধ্যে ফেলে দেয়।
এ তেল এখন দেশটির ৯০ শতাংশ রফতানি আয় এবং সরকারি রাজস্ব আয়ের অর্ধেক জোগান দেয়।
আর এ অতিনির্ভরতা তেলের বাজারের সঙ্গে দেশটির অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন করে তোলে।
২০১৪ সালের তেল দুর্ঘটনা থেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশটির অর্থনীতি।
আর শিগগিরই এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।
এরই মধ্যে বিশ্বের দরিদ্র রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে নাইজেরিয়া।
সুতরাং জনসংখ্যা আরো দরিদ্র সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে।
দেশটির নয় কোটিরও বেশি মানুষ অতিদারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, যা ভারতের চেয়েও বেশি।
অথচ ভারতের জনসংখ্যা দেশটির চেয়ে সাত গুণ বেশি।
কভিড-১৯ মহামারী দেশটির এমন পরিস্থিতিকে আরো সংকটপূর্ণ করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, কভিডের প্রভাবে নাইজেরিয়ানদের ব্যক্তিগত আয় চার দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে গেছে।
এ সংকট ২০২২ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বর্তমানে তিনজনের একজন নাইজেরীয় কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন।
বেকারত্বের এ হার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি।
পাশাপাশি সামাজিক অসন্তোষ ও নিরাপত্তাহীনতা সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারির নীতিগত ভুল পদক্ষেপও দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথকে জটিল করে তুলেছে।
২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসা বুহারি তার প্রথম চার বছরের মেয়াদে ১ কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
অথচ তার দ্বিতীয় মেয়াদের অর্ধেকে এসে দেশটির বেকারত্ব এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বেড়েছে।
৭৮ বছর বয়সী বুখারি টুথপিক থেকে সিমেন্ট পর্যন্ত কয়েক ডজন পণ্য আমদানিতে বিদেশী মুদ্রা নিষিদ্ধ করেছেন, চাল পাচার বন্ধে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছেন এবং মুদ্রা বিনিময় কঠিন করেছেন।
এমন নীতি বৈদেশিক বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
মহামারী মোকাবেলায়ও সরকার অনেক ভুল করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে জাতিগত ও ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত নাইজেরিয়ার প্রধান তিনটি অঞ্চলকে অদ্ভুতভাবে একীভূত করা হয়েছিল।
এর পরের ইতিহাসটি প্রচণ্ড সংঘাতপূর্ণ।
১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বের খ্রিস্টানরা উত্তরাঞ্চলের মুসলিমদের সঙ্গে ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে।
আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য কার্নেগি এন্ডোমেন্টের আফ্রিকান প্রোগ্রামের পরিচালক জয়নব উসমান বলেন, নাইজেরিয়াকে গড়ার জন্য যে ধরনের গভীর, দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি বিশাল বাধা।
রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও দারিদ্র্য সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে।
২০১৫ সালে বুখারি জঙ্গি সংগঠন বোকো হারামকে পরাজিত করার দাবি করলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক দশক ধরে বিদ্রোহ চলছে।
জলদস্যুতা গিনিয়া উপসাগরকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক অঞ্চলে পরিণত করেছে।
দেশটিতে প্রায়ই যাযাবর ও কৃষকদের মধ্যে সংঘাতের খবর পাওয়া যায়।
এগুলোর পাশাপাশি অপহরণ এক দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের পর প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় থেকে অপহরণ করা হয়েছিল।
অফিশিয়াল অনুমান অনুযায়ী, নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় প্রতিবন্ধকতা বিশৃঙ্খলা।
এ কারণে দেশটির অর্থনীতিতে ২০২০ সালে ১ হাজার ৩০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে।
এটা গত বছর কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্বের চেয়েও বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, মূল সংস্কার ব্যতীত নাইজেরিয়ার অর্থনীতি এভাবেই ভুগতে থাকবে।
দেশটির অর্থনীতি ২০২১ ও ২০২২ সালে ২ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি প্রসারিত হবে এবং এটা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচেই থেকে যাবে।
এরই মধ্যে সরকার ঋণের ওপর টিকে আছে।
বর্তমানে দেশটির মোট আয়ের ৮০ শতাংশই চলে যাচ্ছে ঋণের ব্যয় মেটাতে।
উদীয়মান অর্থনীতির ব্যাংক রেনেসাস ক্যাপিটাল ব্যাংকের বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসন বলেন, বিষয়গুলো যদি পরিবর্তন না হয়, তবে দেশটি শিগগিরই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে যেতে পারে।