সিটি গ্রুপের আখের চিনি বিপণন কৌশল প্রশ্নবিদ্ধ

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশে আখ থেকে উৎপাদিত চিনির চাহিদা রয়েছে। আখের চিনি উৎপাদন বাজারজাতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) তবে বেসরকারিভাবে বাজারে আখের চিনি বিক্রি করছে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি তাদের বাজারজাত করা চিনির মোড়কে শতভাগ আখ থেকে উৎপাদিত বলে উল্লেখ করছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আখের অপরিশোধিত চিনি থেকে উৎপাদনের মাধ্যমে শতভাগ ঘোষণা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বিষয়টি বুঝতে বাজার থেকে সিটি গ্রুপের এক কেজির একটি প্যাকেট সংগ্রহ করা হয়। পরিশোধিত চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য রাখা হয় ৭৮ টাকা। মোড়কে উল্লেখ করা হয়েছে, ১০০ ভাগ আখ থেকে তৈরি। যেকোনো প্যাকেটজাত পণ্যের মোড়কে তার উপকরণ উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। তবে সিটি গ্রুপের ওই চিনির মোড়কে তা দেখা যায়নি। বরং উপাদান লেখার স্থানে পরিশোধিত সালফারমুক্ত চিনি কথাটি লেখা হয়েছে। অন্যদিকে মোড়কের পেছনের অংশে পুষ্টিতথ্য সংযোজন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ পণ্য তৈরির উপকরণের কথা উল্লেখ না করেই পুষ্টিতথ্য যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি মোড়কে আখের ছবি সংযোজনের মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বিএসএফআইসি ১৫টি মিলে উৎপাদিত আখের চিনি ডিলার, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। একসময় এসিআই প্রাণ গ্রুপ সীমিত পর্যায়ে বিএসএফআইসি থেকে আখের চিনি কিনত। তবে সেটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মজুদ কম থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ডিলার পর্যায়েও চিনি বিক্রি কমানো হয়েছে। অথচ সারা দেশে সিটি গ্রুপ শতভাগ আখের নামে আমদানীকৃত অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন করে বিক্রি করছে, যেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএসএফআইসির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাযহার উল হক খান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানই আখের চিনি উৎপাদন বিপণন করে না। কেবল নিবন্ধিত ডিলারদের কাছেই খোলা চিনি বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি মোড়কজাত করার মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য সীমিত পরিসরে আখের চিনি বিক্রি করা হয়।

অন্য প্রতিষ্ঠানের আখের চিনি বিপণনের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে আখের চিনি বিক্রির বিষয়টি আমরাও শুনেছি। আখের চিনি নাম দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানই চিনি বিক্রি করুক, সেগুলো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তবে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো সুগার বিট আমদানি হয় না। আখের সুগার (অপরিশোধিত চিনি) আমদানি হয়। পরে মোলাসেস ফেলে দিয়ে অধিকতর পরিশোধন করা হয়। কারণেই বেসরকারি মিলগুলোর চিনির রঙ সাদা হয়। যার কারণে অনেকেই এগুলোকে আখের চিনি নয় বলে মনে করে। বরং অধিক পরিশোধনের কারণে বেসরকারি মিলের চিনি স্বাস্থ্যসম্মত। সরকারি মিলে উৎপাদিত চিনির মধ্যে মোলাসেস থাকায় সেটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তবে তার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিএসএফআইসির প্রধান রসায়নবিদ আহমাদ মসীহুর রহমান। তিনি বলেন, ১৯৩৩ সাল থেকে সেতাবগঞ্জ, নর্থবেঙ্গল, কেরুসহ বিভিন্ন মিলে চিনি উৎপাদন হয়ে আসছে। এসব মিলে উৎপাদিত চিনিতে মোলাসেস থাকলেও তা খুবই সামান্য পরিমাণে ফুডগ্রেড। আমরা তিনটি স্তরে চিনি উৎপাদন করি। গ্রেড চিনিকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। এরপর বি সি গ্রেড থেকে উৎপাদিত চিনি প্রথম ধাপে নিয়ে ফের চিনি উৎপাদন করা হয়। সি গ্রেডের চিনি থেকে যে মোলাসেস উত্পন্ন হয় তা দিয়ে চিটাগুড় তৈরি হয়। ওই চিনি (সি গ্রেডের) আবার পরিশোধনের মাধ্যমে প্রথম গ্রেডের বাণিজ্যিক চিনি উৎপাদন করা হয়। এসব চিনি উৎপাদনকালে সাদা থাকলেও বাতাসের আর্দ্রতার সঙ্গে মিশে কিছুটা বাদামি বা লালচে রঙ ধারণ করে। স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে এমন কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার হয় না। কারণেই সরকারি মিলের চিনি লালচে। ফলে রাষ্ট্রীয় মিলের চিনিগুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকিবিষয়ক যেকোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসএফআইসির গবেষণা রসায়ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতের মিলগুলো সুগার আমদানি করে। পরে পরিশোধনের মাধ্যমে তা বাজারজাত করে। ফলে এসব সুগারে কোনোভাবেই শতভাগ আখের উপাদান থাকার সম্ভাবনা নেই। ব্রাজিলেও সুগার উৎপাদন কমেছে। যে কারণে দামও অনেক বেশি। তাছাড়া ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুগার উৎপাদন বিপণন কার্যক্রম কমে এসেছে। এতে সুগার বিটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বিশ্বের চিনি শিল্প। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সুগার আমদানির মাধ্যমে চিনি উৎপাদন করায় সরাসরি আখ থেকে তৈরিএমন কথা লিখতে পারে না। মূলত আখের চিনির চাহিদা বাড়তে থাকায় বেসরকারি মিলগুলো মোড়কে আখের ছবি ব্যবহার করে ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে।

এদিকে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশে বিট সুগার আমদানি হয় না বলে দাবি করলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের নথি বলছে অন্য কথা। নথিতে দেখা গেছে, চিনির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিট দুই ধরনের সুগারই নিয়ে আসেন। অর্থাৎ চিনি উৎপাদক পরিশোধক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরে থেকে বিট সুগার দুটিই আমদানি করে। তারপর তা পরিশোধিত করে সাদা চিনিতে পরিণত করে।

জানা গেছে, সরকারি মিলগুলোর মধ্যে পঞ্চগড় সুগার মিল, ঠাকুরগাঁও, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, নর্থবেঙ্গল, পাবনা, কুষ্টিয়া, কেরু অ্যান্ড কোং, মোবারকগঞ্জ, ফরিদপুর জিলবাংলা সুগার মিল আখ থেকে সরাসরি চিনি উৎপাদন করে। সর্বশেষ উৎপাদন মৌসুমে আখ সংকটে পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা কুষ্টিয়া চিনিকল বন্ধ রাখা হয়। ৪৮ হাজার ৮১ টন উৎপাদনের পাশাপাশি আগের মজুদসহ বিএসএফআইসির কাছে বিক্রিযোগ্য চিনি ছিল লাখ হাজার ১২ টন। সর্বশেষ ১০ জুন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৭৫ হাজার ৬০৯ টন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির কাছে মজুদ রয়েছে মাত্র ২৮ হাজার ৫০৩ টন। এর মধ্যে সরকারি খাত অর্থাৎ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, মিলস রেশন চাষী খাতের জন্য সংরক্ষিত হাজার ৯৬৭ টন। এরপর মজুদ চিনির পরিমাণ মাত্র ২০ হাজার ৫৩৫ টন।

কয়েক মাস আগেও ঢাকায় প্রতিদিন ১০০ টন আখের চিনি এক দুই কেজির মোড়কে খুচরা বাজারে বিক্রি করত বিএসএফআইসি। তবে মজুদ কমে যাওয়ায় বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে ১০০ টনের মতো চিনি খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে সরকারি মিলের উৎপাদিত চিনি কোনোভাবেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছে বিএসএফআইসি কর্তৃপক্ষ।

বিএসএফআইসি আরো জানিয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাজিল, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সুগার আমদানির মাধ্যমে চিনি উৎপাদন করে। বা অপরিশোধিত তরল সুগার থেকে চিনি উৎপাদন করায় সরাসরি আখ থেকে উৎপাদিত চিনি ঘোষণা দিয়ে তারা বাজারজাত করতে পারে না। এর পরও সিটি গ্রুপ বা দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিনি বিপণনে অনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।

এর আগে গত এপ্রিল চট্টগ্রামে সাদা চিনির সঙ্গে রঙ মিশিয়ে সরাসরি আখের চিনি হিসেবে বিক্রির প্রমাণ পায় প্রশাসন। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন কেয়া কনজিউমার ব্র্যান্ডের খাঁটি দেশী আখের চিনি বিক্রির সময় ১২০ প্যাকেট চিনি জব্দ করেন। মূলত দেশের বাজার থেকে সাদা চিনি সংগ্রহ করে সেগুলোতে রঙ মিশিয়ে এসব চিনি বিক্রি করার প্রমাণ পায় স্থানীয় প্রশাসন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন