পেশাগত ও মানসিক চাপে নার্স

মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্যই নার্সদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা জরুরি

যেকোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হলেন নার্স। কভিড-১৯ মহামারীতে অনেক নার্স সামনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। তথাপি তাদের কর্মপরিবেশ উপযুক্ত নয়। পেশাগত মানসিক চাপে তারা বিপর্যস্ত। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও আছে দশমিক ৩০ জন। নার্সের স্বল্পতার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশ নার্স নিজ কর্মস্থলে তুলনামূলক খারাপ পরিবেশে কাজ করেন, যা উদ্বেগজনক। যারা রোগীর সেবা প্রদান করবেন, তাদের কর্মপরিবেশ ভালো না হলে মানসম্পন্ন সেবা কীভাবে মিলবে? সামাজিক বৈরিতা, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, রোগীর স্বজনদের অসদাচরণ, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা, পদোন্নতির ঘাটতির কারণে নার্সদের ওপর পেশাগত চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশের নার্সদের হতাশার সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে নার্স হিসেবে তাদের সামাজিক ভাবমূর্তি। নার্সিং পেশাকে এখানে সম্মানজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। 

পশ্চিমা দেশগুলোর নার্সদের মতো ভাবমূর্তি আমাদের দেশের নার্সদের নেই। বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের নার্সদের ভূমিকা পশ্চিমাদের চেয়ে ভিন্ন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নার্সদের ক্ষেত্রে অসুস্থকে সেবা করো বা শিশুকে সেবা করো’—এসব ধারণা অনুপস্থিত। এখন নার্স আর রোগীর মধ্যে কোনো বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তাছাড়া নার্স রোগীর অনুপাত এতই কম যে তাদের পক্ষে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব রোগীর যত্ন নেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া হাসপাতাল থেকে তাদের যা সরবরাহ করা হয়, তা দিয়ে রোগীদের যত্ন নেয়া সম্ভব হয় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন হাসপাতালগুলোয় আমলাতান্ত্রিকতা শুরু হলো, তখন নির্ধারিত কাজের বাইরেও নার্সদের দিয়ে নতুন নতুন কাজ করানো শুরু হয়। যেমন প্রশাসনিক কাজ, কেরানির কাজ ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি হচ্ছে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ লোকবলের অভাবে। নার্সদের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় পেপারওয়ার্ক করতে করতে। রোগীকে সেবাদানের কাজটি বলতে গেলে তাদের দিয়ে আর হয় না। ফলে তারা আর রোগীদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান না। রোগী এবং তার স্বজনদের অভিযোগও আর শোনা হয় না তাদের। এটি কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রাপ্তি থেকে রোগীদের বঞ্চিত করছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন।

মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া নার্সদের কর্মপরিবেশ, সুযোগ-সুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। আলো-বাতাসের সুব্যবস্থা থেকে শুরু করে তাদের কাজেরও বিধিবিধান রয়েছে। দেশগুলোর নার্সদের সেবার মান আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত সম্প্রসারিত হচ্ছে। নার্সদের চাহিদাও বাড়ছে। সেক্ষেত্রে তাদের মানসম্পন্ন সেবা পেতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবিসহ কর্মপরিবেশ উন্নত করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। করোনার মধ্যেই বেতন-ভাতা কর্মপরিবেশের দাবি আদায়ে নিউজিল্যান্ডের নার্সরা আন্দোলনে নেমেছিল। বাংলাদেশে নার্সদের অধিকার রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে আরো সক্রিয় হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নার্সদের জন্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠাসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন নার্সিং পেশার মান বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ। আর এটি শুরু হতে পারে কর্মপরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে।

নার্সদের সামাজিক মর্যাদা নিম্ন হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে তাদের নিম্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। নার্সদের বেশির ভাগই আসেন দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের অনেকে বিধবা এবং নিঃস্ব বা সুবিধাবঞ্চিত, যাদের সামাজিক মর্যাদা নিম্ন। পেশাগত ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নার্সদের তাদের অধস্তন বিবেচনা করেন। নার্সিং পেশার ব্রিটিশ মডেল এবং বাংলাদেশের সামাজিক নিয়মের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। নার্সদের কাজের পরিবেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কক্ষে আলোকস্বল্পতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বাতাস চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত স্থানের কারণে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো নয়। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে পেশাগত চাপ সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, নার্সদের সহায়ক সামাজিক পরিবেশ এখনো তৈরি করা যায়নি। কারণে তারা পরিবার সমাজের চাপে থাকেন, তার প্রতিফলন কর্মক্ষেত্রে পড়ে। কাজের পরিবেশ উন্নত করা গেলে তাদের সেবার মানও বাড়বে।

বাংলাদেশী নার্সদের ভূমিকা, ভাবমূর্তি উদ্বেগ আন্তর্জাতিক নার্সিং পেশার আদর্শ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশ্বের আর সব দেশে যেভাবে নার্সিং পেশার চর্চা করা হয়, বাংলাদেশে সেভাবে চর্চা করা হয় না। লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প ভাবমূর্তির বদলে তারা বিরক্ত, হতাশায় পরিপূর্ণ নারী, যারা কিনা রোগীদের সেবাদানের চেয়ে ফাইল রেজিস্টার খাতা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। নার্সদের এই পরিবর্তিত ভূমিকা বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে জনশক্তি ঘাটতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে নার্সিং পেশার নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে  নারীদের নৈতিকতা সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সমাজের মূল্যবোধগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এটির পরিবর্তন প্রয়োজন।

সরকার নার্সদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতের জন্য নার্স মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কাজ হওয়া উচিত হাসপাতালগুলোয় নার্সদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ করা। কাগজপত্রসংক্রান্ত চাপ কমাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নার্স স্টেশন নার্সদের অবস্থান কক্ষে কী কী থাকা বাধ্যতামূলক, তা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশের নার্সদের সেবার মান বিশ্বে প্রশংসিত। এর পেছনে প্রশিক্ষণের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি উন্নত কর্মপরিবেশও কম অবদান রাখছে না। আমরা নার্সদের সুযোগ-সুবিধা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত না করতে পারলেও মধ্যম পর্যায় নিশ্চিত করা যায় কিনা, তার উদ্যোগ নিতে হবে। ভুললে চলবে না, রোগীদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতের জন্য নার্সদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন