৪১ হাজার কোটি টাকা বাজার মূলধনের কোম্পানি ওয়ালটন

পরিচালকদের ঐক্য অটুট থাকবে তো

বদরুল আলম ও মেহেদী হাসান রাহাত

দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাজার মূলধন সবচেয়ে বেশি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। গতকাল পর্যন্ত কোম্পানিটির বাজার মূলধন ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তালিকাভুক্তির এক বছরেরও কম সময়ে ওয়ালটনের ভ্যালুয়েশন বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। বাজার মূলধনে এমন উল্লম্ফনের মধ্যেই কোম্পানিটির একজন প্রভাবশালী এককভাবে সবচেয়ে বেশি শেয়ারধারী পরিচালক স্বতন্ত্র ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্নওয়ালটন পরিবার এক থাকছে তো?

ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০২০ সালে তালিকাভুক্ত হয়েছে পুঁজিবাজারে। এককভাবে কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ারধারী উদ্যোক্তা পরিচালক এসএম আশরাফুল আলম। সম্প্রতি তিনি পৃথক কোম্পানির মাধ্যমে স্বতন্ত্র ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে মিরসরাইয়ে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে জমি বরাদ্দ নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তিনি। নতুন কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজধানীর গুলশানে অফিস নেয়া হয়েছে।

পর্ষদে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা জানতে চাইলে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম মুর্শেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ব্যবসা ভালো করছি। আমাদের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণের কাছাকাছি। পর্ষদ স্বাভাবিক গতিতে কাজ করে যাচ্ছে। কারো কোম্পানি ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। হয়তো ভুলভাবে বলা হচ্ছে। মুখরোচক কিছু কথাবার্তাও হয়তো হচ্ছে। এটির কোনো বাস্তবতা থাকলে আমার জানার কথা।

ওয়ালটনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালে। এরই মধ্যে এটি দেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রনিকস হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুঁজিবাজারে আসে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটির শেয়ারের ভ্যালুয়েশন ছিল হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল লেনদেন শেষে ভ্যালুয়েশন দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ১৯২ কোটি টাকায়। এত কম সময়ে বাজার মূলধনে এমন উল্লম্ফন দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি।

বাজার মূলধনের দিক দিয়ে এরই মধ্যে গ্রামীণফোন বাদে তালিকাভুক্ত স্থানীয় বহুজাতিক সব কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গেছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। ডিএসইর গতকালের বাজার মূলধনের দশমিক শতাংশ দখলে নিয়ে গ্রামীণফোনের পরেই রয়েছে ওয়ালটন। বাজার মূলধনে ওয়ালটনের পরে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), রবি আজিয়াটা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ইউপিজিডিসিএল), রেনাটা লিমিটেড, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বেক্সিমকো লিমিটেড। এগুলোর সবই বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। আয় মুনাফার দিক থেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শত বছরের পুরনো বহুজাতিক ইলেকট্রনিকস হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক সিঙ্গার বাংলাদেশকেও ছাড়িয়ে গেছে ওয়ালটন।

ওয়ালটন গ্রুপ মার্সেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এসএম নজরুল ইসলাম। ১৯৭০ সালে ইস্পাত শিল্পের মাধ্যমে তার ব্যবসার যাত্রা। ১৯৭৭ সালে তিনি রেজভি অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার সংক্ষিপ্ত রূপ আরবি গ্রুপ। তবে ওয়ালটনের ব্যবসার প্রসার হয়েছে এসএম নজরুল ইসলামের ছেলে এসএম নুরুল আলম রেজভির হাত ধরে, যিনি বর্তমানে ওয়ালটন গ্রুপের চেয়ারম্যান।

বর্তমানে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের মোট শেয়ারের ৯৯ দশমিক শূন্য শতাংশই রয়েছে এর উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। বাকি শেয়ারের দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।

পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির বাজার মূলধনে উল্লম্ফনের প্রভাবে এর উদ্যোক্তা পরিচালকেরাও বর্তমানে অন্যতম সম্পদশালীতে পরিণত হয়েছেন। এর মধ্যে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এসএম নুরুল আলম রেজভির কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য দাঁড়িয়েছে হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান এসএম শামসুল আলমের শেয়ারের মূল্য হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। পরিচালক এসএম আশরাফুল আলমের শেয়ারের মূল্য হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। পরিচালক মাহবুবুল আলমের শেয়ারের মূল্য হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, পরিচালক এসএম রেজাউল আলমের শেয়ারের মূল্য হাজার ৩০৩ কোটি, পরিচালক এসএম মনজুরুল আলম অভির শেয়ারের মূল্য হাজার ৭৯ কোটি এবং পরিচালক তাহমিনা আফরোজ তান্না রাইসা সিগমা হিমার প্রত্যেকের কাছে কোম্পানিটির হাজার ২২৩ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার রয়েছে।

জানা গেছে, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোক্তা পরিচালক এসএম আশরাফুল আলম স্বতন্ত্র ব্যবসার কার্যক্রম শুরু করেছেন। জমি বরাদ্দের প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরই কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। চলতি বছরের মধ্যে কারখানা থেকে পণ্য বাজারে আনার পরিকল্পনাও আছে। এসএম আশরাফুল আলমের গড়ে তোলা স্বতন্ত্র কোম্পানির নাম রিমার্ক এইচবি লিমিটেড। এতে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকছেন তিনি। আর তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছেন পরিচালক হিসেবে। রিমার্ক এইচবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফুল আম্বিয়া।

রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, কোম্পানি গঠন হয়ে গেছে। আগামী বছর নাগাদ প্লান্ট চালু করা যাবে বলে আশা করছি। জমি বেজা থেকে বরাদ্দ নেয়া হচ্ছে। ৩০ একর জমি বরাদ্দের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। প্রাথমিক অবস্থায় কোম্পানিতে বিনিয়োগ হবে হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০২৫ সাল নাগাদ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে।

ওয়ালটনের একটি সূত্র জানিয়েছে, আপাতত ওয়ালটনের পর্ষদে কোনো পরিবর্তন আসছে না। তালিকাভুক্ত ওয়ালটনের লভ্যাংশ আয় থেকে পরিচালকরা যে যার মতো বিনিয়োগ করতে চাইছেন। তবে কে কোথায় বিনিয়োগ করবেন, নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। লক-ইন থাকায় মুহূর্তে ওয়ালটনের পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির সুযোগ নেই।

ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের স্বতন্ত্র পরিচালক . আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ওয়ালটনে ভাঙন ধরবে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক, ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা ভালো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও ভালো করবে বলে আশা করছি।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর দিনেই কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩৭৮ টাকায় দাঁড়ায়। সর্বশেষ গতকাল ডিএসইতে হাজার ৩৫৯ টাকা ৯০ পয়সায় ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার লেনদেন হয়েছে।

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আয় হয়েছে হাজার ১০৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ওই হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ ৭২৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) ওয়ালটন হাইটেকের আয় দাঁড়িয়েছে হাজার ২৯১ কোটি টাকায়। আগের বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে রেফ্রিজারেটর (ফ্রস্ট নন-ফ্রস্ট), কম্প্রেসর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, টিভি, মাইক্রোওয়েভ ইলেকট্রিক ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, জেনারেটর, ব্যাটারি, ওয়াটার পাম্প, ফ্যান, এলিভেটর এবং কিচেন হোম অ্যাপ্লায়েন্স। বিদেশে রেফ্রিজারেটর, কম্প্রেসর এর যন্ত্রাংশ, টিভি এয়ারকন্ডিশন রফতানি করছে তারা। ওয়ালটন ব্র্যান্ডের পাশাপাশি মার্সেল ব্র্যান্ডের পণ্যও বিক্রি করে কোম্পানিটি। কভিডের সময়ে কোম্পানিটি নিজেদের কারখানায় ভেন্টিলেটর উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে।

ব্যবসার স্থানীয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশির ভাগ পারিবারিক ব্যবসা তৃতীয় প্রজন্মের বেশি টিকে থাকে না। বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবসা টেকসই না হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মুখ্য হয়ে উঠছে তার মধ্যে আছে পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের ত্যাগ ধৈর্য, পেশাগত দক্ষ লোকবল নিয়োগ না করে শুধু পরিবারের লোক দিয়েই ব্যবসা পরিচালনা উচিত কিনা সে ব্যাপারে দ্বিমুখী অভিমত, পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা ব্যবসার কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণে পূর্ববর্তী প্রজন্মের সদস্যদের দ্বারা অনুমোদন-সংক্রান্ত জটিলতা। এছাড়া পারিবারিক লোক দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী প্রজন্মের পক্ষ থেকে যথাযথ পরামর্শ প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ব্যবসা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়ই কর্তৃত্ব নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসাগুলোতে।

অর্থনীতির বিশ্লেষক মামুন রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় আসার ইতিহাস দুই ধরনের। এর মধ্যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন এমন উদ্যোক্তা রয়েছেন। অন্যদের ব্যবসার শুরু পারিবারিকভাবেই। প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে পারলে পারিবারিক ব্যবসা টেকসই হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন