এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ

ভোক্তার কাছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কার্যকারিতা প্রশ্নবিধ হচ্ছে

গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম নির্ধারিত হয় গণশুনানির মাধ্যমে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্ধারিত দামে কোথাও এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হয়নি। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিইআরসি বা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়। এরই মধ্যে আবার এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণের জন্য এলপিজি বিপণনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিইআরসিতে আবেদন করেছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিষয়টি আমলে নিয়ে দাম নির্ধারণের জন্য গণশুনানিরও উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এতে এলপিজির মূল্যবৃদ্ধিরও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। দুই মাসের মধ্যেই এলপিজির দাম নির্ধারণের উদ্যোগটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এতে ভোক্তার কাছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কার্যকারিতাও প্রশ্নবিধ হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে বাজার শক্তি, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শক্তি সক্ষমতা, আইনি কাঠামো তদারকি ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। হতাশাজনক বিষয় হলো, সিদ্ধান্ত নিয়েও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেটি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এতে ভোক্তা স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। বাজার প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা যায় কিনা, সেটিও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

পণ্যের দাম নির্ধারণে বিশ্বে যে কয়েকটি পদ্ধতি অনুসৃত হয়, তার মধ্যে দুটো প্রসিদ্ধ। একটি হলো বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাহিদা জোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ এবং অন্যটি সরকার বা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কর্তৃক দাম নির্ধারণ। সাধারণত জনগুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়। অন্যান্য পণ্যের দাম বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নির্ধারণ হয় এবং তা সময়ে সময়ে ওঠানামাও করে। উন্নত বিশ্বে উভয় ব্যবস্থাই কার্যকরভাবে চালু রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ উভয়ই ভঙ্গুর এবং সঠিকভাবে কার্যকর নয় সেখানে পণ্যের দাম নির্ধারণ তার বাস্তবায়ন দুরূহ বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ব্যবসায়ী বা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী এবং তাদের দরকষাকষির ক্ষমতাও বেশি। অনেক সময় তারা কার্টেল করার মাধ্যমে পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারেও তাদের প্রভাব থাকে বেশি। ভোক্তার অবস্থান থাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা শক্তিশালী না হলে তাদের ব্যবহার করে বেশি দামে পণ্য বিক্রির অনুমোদন হাসিলের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এলপিজির ক্ষেত্রে এমনটি হলে অতিরিক্ত দাম আইনগত ভিত্তি পেয়ে যেতে পারে।

অবস্থাদৃষ্টে কথা প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে এলপিজি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে বাজার শক্তি নিয়ন্ত্রণ শক্তি কোনোটিই কাজ করছে না। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দেয়ার একটি শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বাজারের চাহিদা জোগানের মাধ্যমে পণ্যটির দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানি অনৈতিকতার আশ্রয় নিচ্ছে কিনা, সেটি দেখে ব্যবস্থা নেয়ার মতো অবকাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারের লক্ষ্য হতে পারে এলপিজির বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। কথা সত্য, বর্তমান বাজারে চাহিদার তুলনায় এলপিজি জোগানের স্বল্পতা রয়েছে। এক্ষেত্রে বাজারে প্রতিযোগিতা পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি, যে কোম্পানি কম দামে এলপিজি সিলিন্ডারের গ্যাস সরবরাহ করবে ভোক্তা সেটিই কিনবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সংস্থা যদি সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে দেয়, তবে কম দামে ভোক্তার সিলিন্ডারের গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। আবার প্রতিযোগিতার পরিবেশও বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। তাছাড়া প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে চাপে রাখতে ব্যবসায়ীদের জোটবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কার্যকর না হলে ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয় না, বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেটি হয়ে থাকে। এখানে ভোক্তাদের বড় ধরনের অভিযোগ আছে বলেও জানা যায় না। এলপিজি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে এমন নীতি অনুসরণ করা যায় কিনা, তা বিশ্লেষণ করে দেখা হোক।

এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রপেন বিউটেন আমদানি করা হয়। বিশেষ করে সৌদি আরব, ওমান দুবাই থেকে। প্রতি মাসে উল্লিখিত দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরামকো। এটি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। আমদানিনির্ভর হওয়ায় এলপিজি বাজারে উদ্বায়িতা প্রবল। বিশ্ববাজারের অস্থিশীলতার প্রভাব এখানে সহজেই পড়ে। শুধু আমাদের দেশে নয়, ভারতেও একই অবস্থা। ভারতে এলপিজির দাম নির্ধারণ হয় ইমপোর্ট প্যারিটি প্রাইস (আইপিপি) ফর্মুলার ভিত্তিতে। সঙ্গে বিবেচনায় থাকে ফ্রেইট, বোতলজাত করার ফি, বিপণন ফি, মূসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সঙ্গে আমলে নেয়া হয় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারও। এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার কারণে দেশটিতে এলপিজির দাম নির্ধারণ একই সঙ্গে গ্রাহক ব্যবসায়ীবান্ধব। এতে উভয়েরই স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। এলপিজির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার কস্ট মডেলিংও আমলে নেয়া যেতে পারে। দেশটি কোথায় কোথায় খরচ বেশি, কেন বেশি, কীভাবে কমানো যায় প্রভৃতি বিষয় অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে। সবখানে দামের সমরূপতা বজায় রাখতে প্রয়োজনে ভর্তুকি দেয়, যাতে গ্রাহকের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি পৌঁছানো যায়; আবার ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত না হন। কস্ট মডেলিংয়ের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশগুলোর নীতি, কৌশল অভিজ্ঞতা আমাদের এখানে আমলে নেয়া যেতে পারে।

কথা সত্য যে এলপিজি খাতে বিগত বছরগুলোয় বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। বিভিন্ন কোম্পানি ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। বাবদ গুনতে হচ্ছে সুদ ব্যয়। উপরন্তু খাতে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। অবস্থায় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বহিঃস্থ ফ্যাক্টরসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচিত না হলে ব্যবসায় ঠিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে গ্রাহকের কাছেও সাশ্রয়ী দামে এলপিজি পণ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে না। তাই দুটোর মধ্যে একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ভবিষ্যতে এলপিজির বাজার আরো সম্প্রসারিত হবে। গ্রাহক যেমন বাড়বে, তেমনি অপারেটরদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বাড়বে। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করলেই হবে না, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও নিয়মিত তদারক করতে হবে। যদি সেটি না হয়, তবে বাজার শক্তি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কোনোটিই কাজ করবে না। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কার্যকর না হলে বাজারের মাধ্যমে এলপিজির দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় কিনা, সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে। বাজার ব্যবস্থা কার্যকর না হলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি বিইআরসি বাজার কোনোটিই ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে না। এক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন তাতে ভোক্তা যেন বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন