স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেকটা এগিয়েছে দেশের মঞ্চনাটক ও শিল্পচর্চা।
তার পরও সংশ্লিষ্টদের পথ চলতে হয় নানাবিধ সংকটকে সঙ্গী করে।
দুই দফা করোনার আঘাতে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে মঞ্চকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা।
ফলে নাট্যকর্মী হারানোর পাশাপাশি দর্শক হারানোর শঙ্কায় আছে দেশের নাট্যজগৎ।
এ অবস্থায় নাট্যকর্মীদের জন্য সরকারি সহযোগিতার অভাব এ সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করেন নাট্যসংশ্লিষ্টরা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনার এই বিরতিতে আমরা অনেক নাট্যকর্মী হারিয়ে ফেলছি।
কর্মহীন, বেকার কর্মীরা গ্রামে চলে যাচ্ছে।
তারা আর ফিরে আসবে কিনা তা নিশ্চিত নই।
এছাড়া দেড় বছরে অনেক বরেণ্য ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি, যা দেশের সংস্কৃতি জগতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ।
এই ক্ষেত্রটা আমাদের নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।’
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের অনারারি প্রেসিডেন্ট, নির্দেশক, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘মঞ্চের কর্মীরা থিয়েটার করে জীবিকা নির্বাহ করে না।
তাদের অন্য কোনো পেশা আছে।
ফলে করোনাকালে তারা কোনোমতে টিকে থাকতে পারছে।
কিন্তু মঞ্চের পেছনে যে টেকনিশিয়ানরা কাজ করে, যেমন মেকআপ আর্টিস্ট, সেট ডিজাইনার, লাইট টেকনিশিয়ানদের দেড় বছর হলো কাজ নেই।’
এ নাট্যসংগঠক আরো বলেন, ‘আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তায় আছি তৃণমূল পর্যায়ের লোকশিল্পীদের নিয়ে।
বিশেষ করে যাত্রাপালায় অভিনয় যাদের জীবিকার প্রধান উৎস।
তারা কোনো কাজ পাচ্ছে না।
তাদের অবস্থা শোচনীয়।’
মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের প্রধান সংগঠক মীর জাহিদ হাসান বলেন, ‘থিয়েটার কর্মীরা থিয়েটারকে পেশা হিসেবে নেয় না।
তাদের জীবনধারণের জন্য অন্য পেশায় যুক্ত থাকতে হয়।
থিয়েটারকে তারা প্যাশনের জায়গায় থেকে দেখে।
কিন্তু থিয়েটারের নেপথ্যে যারা কাজ করে, বিশেষ করে লাইট, সেট, পর্দা, কস্টিউমসহ বিভিন্ন টেকনিশিয়ানদের আয়ের উৎস এটাই।
তারা এ সময়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন।’
এ বিপর্যয় মোকাবেলায় থিয়েটার নেতারা ভূমিকা রাখছেন কিনা জানতে চাইলে মীর জাহিদ বলেন, ‘গত বছর থিয়েটার স্বজন নামে একটা সংগঠন ছয় ধাপে ১১৫ জনকে ১২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিল।
এবারো চেষ্টা করা হয়েছিল।
এবার ঈদের আগে ৪৫ জনকে খুব সামান্য পরিমাণে সহযোগিতা করা হয়।
এ সহযোগিতা খুব বড় কিছু না।
শুধু পাশে থাকা।’ তিনি জানান, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদও এ বছর লকডাউনের শুরুর দিকে নিজেদের ফান্ড থেকে ১০০ নাট্যকর্মীকে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা প্রণোদনা দেয়ার পদক্ষেপ নেয়।
থিয়েটার কর্মীরা সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মীর জাহিদ হাসান বলেন, ‘সব আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
অথচ তারাই অবহেলিত হয়ে আসছে।
মহামারীর সময়েও অবহেলিত হচ্ছে।
নাট্যকর্মীদের প্রতি অবহেলা সংকট বাড়িয়ে তুলছে।’ তবে তিনি জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থিয়েটার কর্মী এবং নেপথ্য কর্মীদের জন্য একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল।
গত বছর বেশকিছু কর্মীকে ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছিল।
শিখণ্ডি কথা, অহম তমস, নিশীমন বিসর্জনসহ ঢাকাই থিয়েটারে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নাটকের মুখ্য এ অভিনেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘এবার করোনা পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমি কিংবা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি আমরা।’
এ অবস্থা মোকাবেলায় করণীয় জানতে চাইলে মীর জাহিদ হাসান বলেন, ‘মাসিক সম্মানী ভাতার আওতায় শিল্পীদের আনা।
সবাই শখের জায়গা থেকে থিয়েটার করে আসছে।
কিন্তু এখন চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে।
জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হচ্ছে।
মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে।
এখন থিয়েটার না করে অন্য কিছু করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে।
মেধাবীরা থিয়েটার থেকে দূরে সরে গেলে মূলধারার সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হবে।
এর জন্য কিছু কর্মীকে মাসিক সম্মানীর আওতায় আনলেই আমাদের সংস্কৃতি বেঁচে যাবে।
আর সংস্কৃতি বাঁচলেই অনেক কিছু রুখে দেয়া সম্ভব।
আমরা তো এখন নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়াচ্ছি।’
রামেন্দু মজুমদার মনে করেন, করোনা কেটে গেলে থিয়েটার আবার নতুন উদ্যমে শুরু হবে।
তবে দর্শক আগের মতো ফিরে পাওয়া কঠিন হবে।
তিনিও সরকারের কাছে থিয়েটার কর্মীদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানান।
পাশাপাশি তৃণমূলের লোকশিল্পীদের দিকে সরকারের বেশি নজর দেয়া উচিত।
গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘বাজেটের ১ শতাংশ শিল্প খাতে বরাদ্দের দাবি ছিল আমাদের।
আমরা পেয়েছি দশমিক শূন্য ৯৭ শতাংশ।
সংস্কৃতির প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট।
রাষ্ট্র শিল্প-সংস্কৃতিকে খুব একটা মূল্যায়ন করে না এটা তার প্রমাণ।’ তিনি মনে করেন, সংস্কৃতিচর্চা দরকার রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের মানুষের জন্য।
সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আরো বলেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা চাই, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি চাই।
তাহলে সংস্কৃতিচর্চায় রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করতে হবে।
বিনিয়োগ না করলে আমরা বুঝব রাষ্ট্র এটা চায় না।’
এত সমস্যার পরও আশাবাদী রামেন্দু মজুমদার। তার কথায়, ‘সংস্কৃতি কখনো বসে থাকে না। সে ঘুরে দাঁড়াবেই। সংস্কৃতি কর্মীরা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শিল্পের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। আমাদের শক্তি অনুযায়ী আবার জেগে উঠব।’