শোষণক্ষম ভূমি হ্রাসই ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে জুন। সেদিন ঘণ্টায় ১১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ঢাকা ওয়াসা বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে যে ড্রেন রয়েছে, সেগুলো ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টির পানি নির্গমনের ক্ষমতা রাখে। ফলে এর বেশি বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা জলজট। যদিও নগরবিদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় উন্নতি করলেই ঢাকার সমস্যার সমাধান হবে না। এর জন্য বাড়াতে হবে সবুজ ভূমি, জলাশয় নিম্নভূমি।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শপথ নেন ঢাকা উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র। শুরু থেকেই জলাবদ্ধতাসহ নাগরিক সমস্যা দূর করতে মাঠে সরব হন তারা। দুই মেয়রই খাল কালভার্ট পরিচ্ছন্ন করার অভিযানে নামেন। সে সময় তারা ঘোষণা দেন যে বছর জলাবদ্ধতামুক্ত ঢাকার দেখা পাবে নগরবাসী। কিন্তু জুনের প্রবল বৃষ্টিপাতের পর রাজধানীর জলাবদ্ধতার চিরচেনা রূপ হতাশ করেছে নগরবাসীকে।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জুন জুলাইয়ে সারা দেশসহ রাজধানীতে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টিপাত হয়। জুনে সাধারণত ১৩৪ মিলিমিটার জুলাইয়ে ১১৪ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এছাড়া এপ্রিলে ১০৪ মে মাসে ১০৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়।

নগরবিদ ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, বৃষ্টির পানি তিনভাবে নিষ্কাশিত হয়। এর মধ্যে মাটি কিছু পানি শোষণ করে নেয়। কিছু পানি জলাশয় নিচু ভূমিতে গিয়ে জমা হয়। আর বড় একটা অংশ ড্রেন হয়ে খাল নদীতে গিয়ে মেশে। ঢাকায় না আছে পর্যাপ্ত জলাশয়, না আছে শোষণক্ষম পর্যাপ্ত ভূমি। ফলে অল্প বৃষ্টিতেও নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তবে দুই মেয়র খাল নর্দমা পরিচ্ছন্ন করার ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় বছর জলাবদ্ধতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না।

তবে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, পর্যাপ্ত জলাশয় শোষণক্ষম ভূমির সমস্যার সমাধান না করে রাজধানীবাসীকে কখনই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। ড্রেন খাল শতভাগ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হলেও জলাবদ্ধতা থেকেই যাবে। কারণ এসব ড্রেন খালের একটি নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা রয়েছে। জলাবদ্ধতার জন্য মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দুষলেন কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে আশঙ্কাজনক হারে শোষণক্ষম ভূমি কমছে। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে। অর্থাৎ ২০ বছরের ব্যবধানে শোষণক্ষম ভূমি কমেছে ২৬ শতাংশ। একই সঙ্গে রাজধানীতে কমেছে খোলা জায়গাও। ১৯৯৯ সালে রাজধানীতে খোলা জায়গা ছিল ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তার পরিমাণ মাত্র দশমিক ৬১ শতাংশ। রাজধানীতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বর্তমানে দশমিক শতাংশ। ২০ বছরে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, একটি বাসযোগ্য নগরীর জন্য যতটুকু শোষণক্ষম ভূমি জলাশয় থাকা আবশ্যক, ঢাকায় তা নেই। পাশাপাশি ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদী খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় রাজধানী। জলাবদ্ধতার জন্য যদিও ওয়াসা বা সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করি আমরা, কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণই এর মূল কারণ। খাল উদ্ধার করেও আসলে নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে না।

ইকবাল হাবিব আদিল মুহাম্মদ দুজনের মতে, যদি রাজধানীর সব খাল সচল হয়, ড্রেনেজ ব্যবস্থা অত্যাধুুনিক করা হয়, তবুও রাজধানীর জলাবদ্ধতা কমবে না। শোষণক্ষম ভূমি নির্ধারিত পরিমাণে বাড়ানো না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না। বলা হয়, বাসযোগ্য শহরের জন্য ২৫ শতাংশ কাঁচামাটি থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কাঁচামাটির পাশাপাশি ১৫ শতাংশ জলাশয়সহ মোট ৩৫ শতাংশ কাঁচামাটি জলাশয়ের ব্যবস্থা করা ছাড়া জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

চলতি বছরের শুরু থেকেই এসব খাল-নর্দমা-বক্স কালভার্ট পরিচ্ছন্নতার কাজে হাত দেয় দুই সিটি। সামান্য বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, এমন পাঁচটি জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে পাইপলাইনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ এরই মধ্যে শেষ করেছে ডিএনসিসি। একইভাবে ডিএসসিসিও এমন ২৫টি জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বণিক বার্তাকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে নগরবাসী এর সুফল পাবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বণিক বার্তাকে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর ঢাকার বাস্তবতার আলোকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৫-৩০ শতাংশ সবুজ ভূমি জলাশয় বাস্তবায়ন অনেকটাই কঠিন কাজ। মুহূর্তে আমাদের যা করণীয় আমরা তা সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছি। এবার ১১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পরও ঘণ্টায় পানি নিষ্কাশন করতে পেরেছি। খাল নর্দমা পরিষ্কারের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঢাকায় এখন জলাবদ্ধতা অর্থাৎ দু-তিন দিন লাগাতার পানি জমে থাকে না। কিছু সময় জলজট হয়। বছর ঘণ্টায় পানি নেমেছে। আগামী বছর আরো কম সময়ে পানি সরে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন