সেরামের ওপর একক নির্ভরতাই টিকা বিপর্যয়ে দায়ী

বণিক বার্তা ডেস্ক

কভিডের চলমান প্রবাহ বিশ্বের অনেক স্থানেই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ-নেপাল থেকে শুরু করে আফ্রিকার রুয়ান্ডাসহ অনেক দেশেই স্বাস্থ্য খাত এখন ভঙ্গুর দশায়। সংক্রমণ শনাক্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে অব্যাহত আকারে। বর্তমান সংকটের জন্য অনেকাংশেই দায়ী করা হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াকে। দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত আগাম বিক্রীত টিকা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। উন্নয়নশীল অনুন্নত দেশগুলোর টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিতে গঠিত বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সেও প্রতিশ্রুত পরিমাণে টিকা সরবরাহ করতে পারেনি সেরাম। অন্যদিকে দেশগুলো টিকার প্রাপ্যতার জন্য সেরামের ওপরই নির্ভর ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একক একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভরতার কারণেই দেশগুলোয় টিকার সংকট দেখা দিয়েছে।

বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট। কভিডের টিকা বাজারে আসার আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে মনোনীত করা হয়। কিন্তু সেরামের ব্যর্থতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে গৃহীত কর্মসূচিটি বিপাকে পড়ে যায়। ফলে বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিতের উদ্যোগটিও স্থবির হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ বলছে, রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডসহ নানাবিধ কারণে ভারতীয় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুত পরিমাণে টিকা সরবরাহ করতে পারেনি সেরাম। প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতা কোভ্যাক্স কর্মসূচিকেও স্থবির করে দিয়েছে।

কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে বিশ্বের ৯২টি দেশে কভিডের টিকা সরবরাহের পরিকল্পনা করেছিল বৈশ্বিক ভ্যাকসিন জোট গ্যাভি। এজন্য সেরামের সঙ্গে কমপক্ষে ২০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহেরও চুক্তি করেছিল কোভ্যাক্স। প্রাথমিকভাবে টিকা সরবরাহের বড় একটি অংশ আসার কথা ছিল সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া না যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক এক সংকটের মুহূর্তে একক একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভরতার খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে।

ডব্লিউএইচও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পর্যাপ্ত মাত্রায় টিকা দিতে না পারায় আগামী দিনগুলোয় বিশ্বব্যাপী কভিডের আরো ভয়ংকর ধরনের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বৈশ্বিক মহামারীটিও দীর্ঘায়িত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কভিডের টিকা উৎপাদন করছে, প্রয়োজনীয় মাত্রায় সরবরাহ দিতে পারছে না। তবে সেরামের ব্যর্থতার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। কারণ কোভ্যাক্স উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিষ্ঠানটির ওপর নির্ভর করেছিল অনেক বেশি। সেরাম প্রয়োজনীয় টিকা সরবরাহ করতে না পারায় দেশগুলোর প্রতিটিই এখন মারাত্মক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে।

ভারত সরকার এপ্রিলে টিকা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই সময় থেকে পর্যন্ত ভারতের বাইরে কোথাও টিকা পাঠাতে পারেনি সেরাম। তবে প্রতিষ্ঠানটির টিকা উৎপাদন নিয়ে সমস্যার শুরু আরো অনেক আগে।

সেরামের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা গত বছর দাবি করেছিলেন, ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় সরবরাহের জন্য কভিডের টিকা উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ কোটিতে নিয়ে যাওয়া হবে। অন্যদিকে সময় পেরোনোর পর চলতি বছরের প্রথম মাসে এসে তিনি জানালেন, সক্ষমতা উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে মাত্র সাত কোটিতে।

প্রতিশ্রুতি বাস্তবতার মধ্যকার বিশাল ব্যবধানের কারণ সম্পর্কে তিনি সে সময় বলেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে কভিড টিকার লাইসেন্স পাওয়া যাবে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউজে টিকা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গাও ছিল না।

সেরামের কাছ থেকে প্রাপ্য সরবরাহ না পেয়ে অনেক দেশই এখন বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নেপাল সরকার সেরামের সঙ্গে সরাসরি ২০ লাখ ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি করেছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত অর্ধেক ডোজ টিকা পেয়েছে দেশটি। যদিও মার্চের মধ্যেই সব টিকা নেপালে চলে আসার কথা ছিল।

নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবার কল্যাণ বিভাগের পরিচালক তারা নাখ পোখরেল বলেন, আমরা টিকার সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে মারাত্মক হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত নেপালের কোটি ৮০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ২৩ লাখ ৮০ হাজার ডোজ সংগ্রহ করা গিয়েছে। এর মধ্যে সেরামের কাছ থেকে কেনা টিকা এসেছে ১০ লাখ। ভারত সরকার উপহার হিসেবে দিয়েছে ১০ লাখ। বাকি টিকার সরবরাহ এসেছে কোভ্যাক্স থেকে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে নেপালের টিকা পাওয়ার কথা কোটি ৩০ লাখ ডোজ। কিন্তু সেরামের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোভ্যাক্সও এখন প্রয়োজনমতো টিকা সরবরাহ করতে পারছে না।

কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি পরিচালিত হচ্ছে ভ্যাক্সিন জোট গ্যাভির তত্ত্বাবধানে। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী সেথ বার্কলে বলেন, বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের সক্ষমতা, কম দামে সরবরাহের সক্ষমতা এবং ডব্লিউএইচওর জরুরি সরবরাহকারী তালিকায় শুরুর দিকে থাকায় সেরামকে কোভ্যাক্সের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল।

বর্তমানে সেরামের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এর পরও কোভ্যাক্স উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টিকার নতুন উৎস খুঁজে নিতে হচ্ছে। কারণ সম্প্রতি সেরাম জানিয়েছে, ভারতের অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠানটির টিকার চাহিদা অনেক বেশি। কারণে চলতি বছরের শেষ দিকের আগে প্রতিষ্ঠানটি টিকা রফতানি পুনরায় চালু করতে সক্ষম হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেরামের ব্যর্থতায় বিশ্বব্যাপী টিকা সরবরাহে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শূন্যতা পূরণের জন্য বর্তমানে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত টিকার নির্ভরতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড এবং সিনোফার্ম গ্রুপ কোম্পানির উৎপাদিত টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ডব্লিউএইচও। অনেক দেশই সেরামের সরবরাহ সংকট দেখা দেয়ার পর কভিডের গণটিকা কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে এসব দেশ চীন থেকে কেনা টিকা দিয়ে ফ্রন্টলাইনার জরুরি কর্মীদের টিকা দিচ্ছে। যদিও গণটিকাদান কর্মসূচি পুনরায় চালু করতে দেশগুলোকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সেরাম ইনস্টিটিউট বর্তমানে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। যদিও বছরখানেক আগেও প্রতিষ্ঠানটির জন্য পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সে সময় ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত কভিডের টিকা উৎপাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সেরাম। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের পাশাপাশি উন্নয়নশীল অনুন্নত দেশেও টিকা সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি সেরামকে বিশ্বব্যাপী পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।

এরও আগে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হাম পোলিও মোকাবেলায় সেরামের টিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও আদর পুনাওয়ালার ভাষ্য ছিল, বিশ্বব্যাপী কভিড মোকাবেলায়ও বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে সেরাম। নভেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি পুনায় অবস্থিত কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে নতুন একটি কারখানা দেখার আমন্ত্রণ জানান। ওই সময় তিনি দাবি করেন, কারখানাটি চালু হলে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টিকা উৎপাদন সক্ষমতা ১০০ কোটি ডোজ ছাড়িয়ে যাবে।

তবে কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম পাবলিক ফোরামে আদর পুনাওয়ালার বক্তব্যও পাল্টে যেতে থাকে। ওই মাসেই এক সাক্ষাত্কারে তিনি দাবি করেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই সেরাম ১০ কোটি ডোজ টিকা প্রস্তুত করে সংরক্ষিত রাখতে চায়। যদিও এরও আগে বছর শেষ হওয়ার আগে ৪০ কোটি ডোজ টিকা প্রস্তুত রাখার কথা বলেছিলেন তিনি। জানুয়ারিতে তিনি সেরামের জরুরি সংরক্ষণের সম্ভাব্য সংখ্যা আরো কমিয়ে আনেন। এবার তা নেমে আসে সাত কোটিতে।

জানুয়ারির শুরুর দিকে ব্লুমবার্গে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে পুনাওয়ালা বলেন, গুদামে জায়গার অভাবে সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন তিনি। এছাড়া ভারতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের বিষয়টিও বেশ সময়সাপেক্ষ। কোম্পানিটি জরুরি ভিত্তিতে টিকা প্রয়োগের আবেদন করেছিল ডিসেম্বরের শুরুর দিকে। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে পুনাওয়ালা সেরামের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি নীতিকে। ওয়াশিংটনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি থেকে ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন তিনি।

এদিকে জানুয়ারিতে সেরামের একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে সময় অগ্নিকাণ্ডের ফলে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেন পুনাওয়ালা। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ফলে সেরামের উৎপাদন গতি হারাবে না। কিন্তু সেরাম-সংশ্লিষ্ট এক সূত্র নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জানিয়েছে, ওই অগ্নিকাণ্ডে বেশকিছু উৎপাদন উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়। এতে টিকা উৎপাদনে অতিরিক্ত সক্ষমতা যোগ করতে দেরি হয়ে যায়। উৎপাদন সম্প্রসারণের বিষয়টি হয়ে পড়ে ধীর।

কভিডের টিকা সরবরাহে সেরামের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ফিউচার ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারিং রিসার্চ হাব ভ্যাকসিন রিসার্চ নেটওয়ার্কের সদস্য ক্লিও কন্টোরাভডি বলেন, মুহূর্তে তারা (সেরাম) সত্যিকার অর্থেই স্থবির হয়ে পড়েছে। কোভ্যাক্সের ওপরও এটি অনেক বড় একটি আঘাত।

বিষয়ে ব্লুমবার্গের পক্ষ থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বেশকিছু প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি। অন্যদিকে সেরামের এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন, পুনাওয়ালাকে মুহূর্তে সাক্ষাৎকারের জন্য পাওয়া সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন