নড়াইলের কালিয়া উপজেলা

দুই কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট উধাও

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, নড়াইল

এজেন্টদের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা হলে তবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রসিদ প্রিন্ট হওয়ার কথা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের প্রকৃত প্রমাণপত্রও সেটি। কিন্তু ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট খায়রুল বাশার নিজেই রসিদ ছাপিয়ে নিয়েছিলেন। ভুয়া সে রসিদ ব্যবহার করেই গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন অন্তত কোটি টাকা। কিন্তু সংগৃহীত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট খায়রুল বাশার উধাও হয়েছেন। মেয়াদি আমানত বিদ্যুৎ বিল হিসাবে প্রায় তিন হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ওই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। ঘটনাটি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি বাজারের।

আমানতের টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা চাচুড়ি বাজারের সেই এজেন্ট আউটলেটের সামনে ভিড় করছেন। যদিও গোপনে সে আউটলেট থেকে কম্পিউটারসহ অন্য জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আর ৫০ হাজার টাকা ভাড়া বকেয়া পড়ায় ভবন মালিক ব্যাংকের আউটলেটে তালা মেরে দিয়েছেন।

ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট খায়রুল বাশারের কাছে লাখ টাকার আমানত রেখেছিলেন ডহর চাচুড়ি গ্রামের মত্স্যজীবী পিটু বিশ্বাস। মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে মাছ বিক্রি করে ওই টাকা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। আরো কিছু টাকা জমিয়ে ঘর বানানোর ইচ্ছা ছিল তার। লাখে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা পাবেন প্রলোভনে পড়ে স্ত্রী লাকিয়ার নামে এজেন্ট খায়রুল বাশারের কাছে রেখেছিলেন পিটু বিশ্বাস। কিন্তু মঙ্গলবার ( জুন) ব্যাংকে এসে জানতে পারেন তার নামে ব্যাংকের হিসাবে কোনো টাকাই জমা হয়নি।

ঘরের জন্য কিছু টাকা জমাইছিলাম। ভাবছিলাম আরো কিছু জমায়ে ঘরটা তুলব। এখন আমার ঘর তোলার স্বপ্নই শেষ হয়ে গেল। এভাবেই ক্ষোভের কথা বলছিলেন সঞ্চয় খোয়ানো পিটু বিশ্বাস।

মত্স্যজীবী পিটু বিশ্বাসের মতোই চাচুড়ি গ্রামের কোহিনুর বেগম আড়াই লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন ব্যাংক এশিয়ার ওই এজেন্টের কাছে। জমাকৃত আমানতের জন্য দুই মাসের মুনাফাও পেয়েছিলেন। কিন্তু মে মাসের মুনাফার টাকা নিতে এসে দেখেন ব্যাংকে তালা মারা।

কাঁদতে কাঁদতে অসহায় কোহিনুর বেগম বলছিলেন, ছেলের পাঠানো টাকা থেকে বাঁচিয়ে অনেক কষ্টে টাকাগুলো সঞ্চয় করেছিলাম। কিন্তু এখন সবকিছুই হাওয়া হয়ে গেছে।

একইভাবে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্টের কাছে জমা রাখা চাচুড়ি গ্রামের মফিজুর রহমানের ১৫ লাখ, পুরুলিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর শেখের ১২ লাখ, হাসান শেখের দেড় লাখ টাকাসহ কয়েকশ গ্রাহকের প্রায় কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। আত্মসাত্কৃত অর্থের মধ্যে রয়েছে প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের জমা দেয়া তিন মাসের বিদ্যুৎ বিলও।

সূত্র মতে, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি বাজারে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট আউটলেটটি ২০১৯ সালের জুনে উদ্বোধন করা হয়। এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ পান স্থানীয় চন্দ্রপুর গ্রামের খায়রুল বাশার। আউটলেটটিতে সঞ্চয় স্কিম (ডিপিএস), মেয়াদি আমানত সঞ্চয়ী হিসাব মিলে হাজার ৩০০ গ্রাহক নিয়মিত লেনদেন করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই মেয়াদি আমানতের গ্রাহক। আবার প্রতি মাসে দুই হাজারেরও বেশি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আউটলেটটির মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুতের বিলও নেয়া শুরু হয়। আশপাশের চার ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার গ্রাহক এখানে বিদ্যুৎ বিল জমা দেন। মার্চ থেকে বিদ্যুৎ বিলে বকেয়া আসতে থাকায় গ্রাহকরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, জমাকৃত বিলের টাকা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে জমা হয়নি। একই অবস্থা এপ্রিল  মে মাসে চলতে থাকে। বিদ্যুৎ বিলের ঘাপলার কারণে ধীরে ধীরে অন্য আমানতের টাকার হিসাবও বের হতে থাকে।

আউটলেট চালুর পর কর্মীদের চাকরি দেয়ার নাম করে ১০-১২ জনের কাছ থেকে থেকে লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন বলেও এজেন্ট খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ফারজানার কাছ থেকে লাখ, ফজিলার কাছ থেকে লাখ, লাকি খানম আর অনিক নামের হিসাবে কাজ করা দুই কর্মীর কাছ থেকে লাখ টাকা নেন খায়রুল। এসব কর্মী এখন রাগে-ক্ষোভে ফুঁসলেও বাইরের গ্রাহকের গালি শুনছেন।

ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টের জালিয়াতিতে ক্ষুব্ধ বাজারটির ব্যবসায়ীরা। চাচুড়ি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, আস্থা বিশ্বাসের কারণেই ব্যাংকের ওই এজেন্টের কাছে মানুষ টাকা রেখেছিল। এখন সে টাকা লুট হয়ে গেছে। আমি প্রশাসনের কাছে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করছি। গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে এজেন্ট পালিয়ে গেল অথচ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা ধরতেই পারলেন না, এটি কেমন কথা।

তবে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নড়াইল জেলা ব্যবস্থাপক ফিরোজ আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা গ্রাহকদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত যেসব অভিযোগ পেয়েছি, তা ৪০ লাখ টাকার বেশি নয়। অভিযোগগুলো যাছাই করা হচ্ছে। এজেন্ট খায়রুল বাশারের কোনো খোঁজ না পেলেও তার পিতা আউটলেটটির দেখভাল করছেন। বর্তমানে আউটলেটটিতে লেনদেন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

ঢাকা থেকে আসা ব্যাংক এশিয়ার নিরীক্ষক আব্দুল্লাহ বাকী বলেন, আমরা গ্রাহকের অভিযোগ সংগ্রহ করছি। এজেন্ট যে ধরনের জালিয়াতি করেছে, তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কালিয়ার ডিজিএম মো. মমিনুর রহমান বিশ্বাস বলেন, এলাকার প্রায় দুই হাজার গ্রাহক সেখানে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ওইসব গ্রাহকের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ লক্ষাধিক টাকা গ্রহণ করলেও এজেন্ট সে টাকা জমা না দেয়ায় গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

নড়াইলের সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়া সার্কেল) প্রণব কুমার সরকার বলেন, পুলিশ চাচুড়ি বাজারের এজেন্ট ব্যাংকিং বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে। এলাকার মানুষের অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও এজেন্ট খায়রুল বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহূত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন