বর্তমান
বিশ্ব আজ
কভিড-১৯
মহামারীর দ্বিতীয়
ঢেউয়ের আঘাতে
স্থবির। বিশেষ
করে এশিয়া,
আফ্রিকা ও
দক্ষিণ আমেরিকার
অঞ্চলগুলোকে কভিডের
আরেক দফা
তরঙ্গ প্রায়
ভাসিয়ে নিয়ে
যাচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্ব
বিশেষত এশিয়া,
আফ্রিকা ও
দক্ষিণ আমেরিকা
কভিড-১৯
মহামারীর দ্বিতীয়
আঘাত সামলাতে
গিয়ে হিমশিম
খাচ্ছে। তবে
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে
জনস্বাস্থ্য সংকটের
দিকে অনেক
বেশি দৃষ্টি
নিমগ্ন করে
আমরা মহামারী-সম্পর্কিত
অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো
উপেক্ষা করার
ঝুঁকি নিচ্ছি,
যা কভিডের
প্রভাব কমার
পর উন্নয়নশীল
দেশগুলোকে বিপর্যস্ত
করে তুলতে
পারে।
বৈশ্বিকভাবে, আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিল
(আইএমএফ) এরই
মধ্যে ‘মহা
বিচ্যুতি’ সম্পর্কে
আমাদের সতর্ক
করে দিয়েছে।
বিশেষ করে
ধনী দেশগুলো
শক্তিশালী পুনরুদ্ধার
কার্যক্রম শুরু
করতে পারলেও
বাকিরা হোঁচট
খাচ্ছে বারবার।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো
দিকনির্দেশনা দেয়
যে বেশির
ভাগ উন্নত
অর্থনীতি, বিশেষ
করে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এবং
হাতেগোনা কয়েকটি
উন্নয়নশীল দেশ,
যেমন ভিয়েতনাম,
থাইল্যান্ড ও
বাংলাদেশ সম্ভবত
সংকট থেকে
বেরিয়ে আসছে
এবং মহামারী
শুরুর আগে
তারা যে
ধরনের প্রবৃদ্ধি
অর্জন করেছে,
তার চেয়েও
দ্রুতগতিতে অগ্রসর
হতে পারে।
তবে উদীয়মান
অনেক অর্থনীতি
এবং নিম্ন
আয়ের দেশগুলোর
অচলাবস্থা কাটিয়ে
উঠতে দীর্ঘ
সময় লেগে
যাবে।
অর্থনীতির মহাবিচ্যুতিগুলোও
দৃশ্যমান। মহামারীর
কারণে হোটেল,
ভ্রমণ, পর্যটন
খাতের অবস্থা
নাজুক হয়েছে,
বিপরীতে ওষুধ
শিল্প, ডিজিটাল
প্লাটফর্ম, নেটওয়ার্কিং
প্রযুক্তি শিল্পের
প্রসার ঘটেছে।
এ অবস্থায়
অবাক হওয়ার
কিছু নেই
যে অনেক
ধনিক শ্রেণী,
বিশেষ করে
যারা ইক্যুইটি
মার্কেট পরিচালনায়
দক্ষ তারা
কভিড-১৯
সংকট পরিস্থিতিতে
খুব ভালোভাবে
কাটিয়ে উঠেছে।
বিপরীতে দরিদ্র
শ্রেণীর মানুষ
মহামারীর কশাঘাতে
বিপন্ন হয়ে
পড়েছে।
আর এখানেই
প্রকৃত বিপদ
নিহিত। মহামারী
দরিদ্রদের মতো
ধনীদেরও সমপরিমাণ
ঝুঁকিতে ফেলেছে।
তবে উন্নয়নশীল
দেশগুলোয় বতর্মানে
যে ধরনের
আর্থিক সংকট
তৈরি হয়েছে,
তা সেখানকার
ধনীদের প্রভাবিত
না করলেও
বা খবরের
শিরোনাম না
হলেও কিংবা
বিষয়টি তেমন
গায়ে না
মাখা হলেও
খুব বেশিদিন
আর তা
উপেক্ষা করা
সম্ভব হবে
না।
এটা নিশ্চিত
যে সমস্যার
সূচনা চূড়া
থেকেই শুরু
হয়। উদীয়মান
অর্থনীতিগুলোর ঋণের
বোঝা বাড়ছে।
জিম্বাবুয়ে কিংবা
আর্জেন্টিনা এরই
মধ্যে ঋণখেলাপি
দেশে পরিণত
হয়েছে। ২০২০
সালে লাতিন
আমেরিকার অর্থনীতি
সংকুচিত হয়েছে
৭ দশমিক
৭ শতাংশ।
ফিলিপাইন ও
ভারতের অর্থনীতি
আরো বড়
ধরনের সংকোচনের
মধ্য দিয়ে
গেছে। যথাক্রমে
তাদের প্রবৃদ্ধি
সংকুচিত হয়েছে
৯ দশমিক
৫ ও
৯ দশমিক
৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ধারণা
করছে, মহামারীর
কারণে আফ্রিকার
চার কোটি
লোক চরম
দারিদ্র্যে পরিণত
হতে পারে।
ভারতে কভিডের-১৯-এর
দ্বিতীয় ঝড়
বয়ে যাচ্ছে,
যা মার্চের
শেষের দিকে
রীতিমতো তাণ্ডব
চালিয়েছে। যদিও
এর অর্থনৈতিক
প্রভাব সম্পর্কিত
পর্যাপ্ত গবেষণা
তথ্য এখনো
পাওয়া যায়নি,
তবে অনুমাননির্ভর
প্রমাণগুলো বিষণ্ন
চিত্রই তুলে
ধরে। সেন্টার
ফর মনিটরিং
ইন্ডিয়ান ইকোনমি
অনুসারে, এপ্রিলে
কাজ হারিয়েছে
৭০ লাখ
মানুষ। ফলে
মার্চে যেখানে
দেশটির বেকারত্বের
হার ৬
দশমিক ৫
শতাংশ ছিল,
এপ্রিলে তা
হঠাৎ করে
একলাফে ৮
শতাংশে পৌঁছেছে।
উপরন্তু, গত
বছর তরুণ
বেকারত্বের হার
২৩ দশমিক
৭৫ শতাংশ
হয়ে সর্বকালের
শীর্ষ চূড়ায়
অবস্থান করছে।
রোজকার খবর
অনুসারে, সত্কার
না করে
মরদেহগুলোকে গঙ্গার
জলে ছুড়ে
ফেলা হচ্ছে,
আর ভারতের
ছোট ছোট
শহর আর
শহরতলি থেকে
মানুষের করুণ
পরিণতির অসংখ্য
খবর ভেসে
আসছে, যা
ঘনীভূত অর্থনৈতিক
সংকটের আভাস
দেয়। বিশেষ
করে হিন্দু
সম্প্রদায় যখন
কোনো মরদেহ
ধর্মীয় রীতিতে
সত্কার না
করে পানিতে
ফেলে দিতে
বাধ্য হয়,
তখন বুঝে
নিতে হবে
তারা অন্য
কোনো উপায়
না পেয়েই
কাজটি করছে।
তারা শ্মশানে
কোনো জায়গা
পাচ্ছে না।
একমাত্র চরম
অভাবগ্রস্ত পরিস্থিতিই
নদীতে মরদেহ
ফেলে দিতে
তাদের বাধ্য
করছে।
পশ্চিম বাংলায়
একটি এনজিও
পরিচালনা করেন,
এমন দুই
নারীর বর্ণনায়
বিষয়টি আরো
করুণভাবে উঠে
এসেছে। সংস্থাটি
মূলত গ্রামীণ
অঞ্চলগুলোয় স্কুলের
পাশাপাশি চক্ষু
হাসপাতাল পরিচালনা
করে। তারা
আমাকে জানিয়েছে
যে কীভাবে
স্বাভাবিক সময়ের
তুলনায় বর্তমানে
তাদের স্কুলে
ছাত্রদের নিবন্ধনের
হার কমে
গেছে, যা
প্রায় অর্ধেকের
কাছাকাছি। আরো
ভয়াবহ তথ্য
হচ্ছে, মহামারীর
কারণে উপজাতি
জনগোষ্ঠী বিশেষ
করে ঝুমুর
গায়ক ও
চাউ নৃত্যশিল্পীদের
মধ্য থেকে
হাজার হাজার
লোক এখন
ভিক্ষাবৃত্তি করে
পেট চালাচ্ছে।
প্রতি মাসে
রাজ্য সরকারের
তরফ থেকে
দেয়া ১
হাজার রুপিই
এখন তাদের
একমাত্র ভরসা।
সম্প্রতি এনজিওটির
পক্ষ থেকে
স্থানীয় লোকজনকে
ত্রাণ দেবে
বলে ঘোষণা
দেয়া হয়।
ত্রাণ বিতরণের
দিন সেখানে
দূর-দূরান্ত
থেকে অনেক
লোক সমবেত
হয়, যারা
ত্রাণ দেয়ার
কথা শুনে
এসেছে। তাদের
কেউ এসেছিল
কয়েক মাইল
পথ পায়ে
হেঁটে কিংবা
সাইকেল চালিয়ে।
এ ধরনের
ঘটনা ছাড়াও
সরকারিভাবে প্রাপ্ত
তথ্যও আশঙ্কাজনক
পরিস্থিতির চিত্র
তুলে ধরছে।
গত মাসে
ভারতের পাইকারি
মূল্যস্ফীতির পরিমাণ
বেড়ে দাঁড়িয়েছে
১০ দশমিক
৫ শতাংশ,
যা গত
১১ বছরের
মধ্যে সবচেয়ে
বেশি। এটি
চাহিদা ও
জোগানের ভারসাম্যহীনতারই
প্রতিফলন। যদি
এখনই তা
ঠিক করা
সম্ভব না
হয়, তাহলে
পরবর্তী সময়ে
এটি বড়
ধরনের সংকটের
দিকে ঠেলে দেবে।
বিশেষ করে
এটি সামষ্টিক
অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার
কারণ হবে,
যা কিনা
অর্থপ্রবাহের পাশাপাশি
ব্যবসা-বাণিজ্যকে
প্রভাবিত করবে।
ভারতের কেন্দ্রীয়
ব্যাংক অনেক
শক্তিশালী কিন্তু
বর্তমানে মহামারীর
কারণে বেশির
ভাগ দেশই
যে ধরনের
সমস্যার মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে,
তা এককভাবে
আর্থিক নীতি
দিয়ে সমাধান
করা কঠিন।
কারণ সমস্যাগুলো
মূলত দুর্বল
সুশাসনের কারণে
সৃষ্টি হয়েছে।
সুতরাং ভারতকে
এ সংকট
মোকাবেলার জন্য
জরুরিভাবে সঠিক
নীতিনির্ধারণে মনোযোগী
হতে হবে।
নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি
উপলব্ধি করা
উচিত যে
যখন অক্সিজেন,
ভ্যাকসিন কিংবা
খাবারের মতো
জরুরি প্রয়োজনীয়
পণ্যের সরবরাহ
ঘাটতি দেখা
দেয়, তখন
আর্থিক সহায়তা
কার্যক্রমগুলো কাজ
না-ও
করতে পারে,
কেননা ধনীরা
যেকোনো মূল্যে
তাদের প্রয়োজনীয়
পণ্য কিনতে
বা চাহিদা
মেটাতে প্রস্তুত
থাকে। তাই
দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে
আর্থিক সাহায্য
প্রদানের পাশাপাশি
এটাও নিশ্চিত
করতে হবে
যে তারা
তাদের প্রয়োজনগুলো
পূরণ করতে
পারছে বা
প্রয়োজনমাফিক পণ্য
ক্রয় করতে
পারছে। কেননা
ধনী লোকদের
প্রয়োজন পূরণ
না হওয়া
পর্যন্ত পণ্যের
দাম বাড়তে
থাকে।
স্থানীয় পর্যায়
থেকে শুরু
করে আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে এ
ধরনের সমস্যা
দেখা যায়,
যেমনটা কভিড-১৯
ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে
হয়েছে। সেখানে
বেশির ভাগ
ধনী দেশ
তাদের প্রয়োজনের
অধিক ভ্যাকসিন
কিনে মজুদ
করেছে, বিপরীতে
দরিদ্র দেশগুলো—এর
মধ্যে আফ্রিকার
একটি বড়
অংশ অন্তর্ভুক্ত—ভ্যাকসিনের
জোগানের সংকটে
পতিত।
এ অবস্থায়
ভারত সরকার
এবং উন্নয়নশীল
দেশগুলোর সরকার
অনেক কিছুই
করতে পারে।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিলের
মতো বহুপক্ষীয়
সংস্থা এবং
জি২০ তালিকাভুক্ত
দেশগুলোকে মিলে
অবশ্যই একটি
কার্যকর নীতিগত
পদক্ষেপ গ্রহণ
এবং সহায়তা
কার্যক্রম ত্বরান্বিত
করতে হবে।
অন্যথায় আজকের
সামান্য অর্থনৈতিক
হুমকিটি আগামীকাল
পত্রিকার প্রথম
পাতার প্রধান
শিরোনাম হিসেবে
প্রকাশিত হবে।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের
সাবেক মুখ্য
অর্থনীতিবিদ ও
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির
অধ্যাপক
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস