আলোকপাত

ন্যায্যতার পরিধি: ডেভিড হিউম ও আমাদের পৃথিবী

অমর্ত্য সেন

[গতকালেরপর]

যুক্তি তো আসলে কাজ করে অন্য কোনো কিছুর ব্যাপারে। স্পষ্টতই নৈতিকতা বাস্তব যুক্তি প্রয়োগে বিভিন্ন উপাদান থাকে, যেমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কতটা জ্ঞান আছে ইত্যাদি ( বিষয়ে হিউম প্রচুর লিখেছেন) অধিকন্তু, আমাদের জীবনে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তি কতটা প্রভাবশালী হতে পারবে, সেটা নির্ভর করবে মানুষের প্রকৃত ভাবাবেগ যুক্তির দ্বারা কতখানি আন্দোলিত হতে পারছে তার ওপর ( বিষয়েও হিউমের অনেক আলোচনা আছে) যুক্তি প্রয়োগ কীভাবে কাজ করতে পারে, সেটি নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রেক্ষাপটে আমরা অনুধাবনটিকে দেখতে পারি। নৈতিকতায় যুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, নির্দিষ্টকরণের কাজ বা প্রক্রিয়া তাকে খাটো করে না; এবং আমরা আসলে কতটা জানি, আমাদের প্রকৃত সংবেদনগুলো (সেন্টিমেন্টস) কী কী কিংবা বিশ্লেষণভিত্তিক নিরীক্ষার পর সেগুলো কী রূপ নিতে পারে ইত্যাদি ব্যাপারে যুক্তিভিত্তিক মতপ্রকাশের ভূমিকাকেও অস্বীকার করে না।

যেখানেই বিবেচনাপ্রসূতভাবে কাজে লাগানো সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রেই হিউম জোরের সঙ্গে যুক্তিকে ব্যবহার করেছেন। তার জীবনের সমগ্র কাজ যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের এক সমৃদ্ধ ছবি। এটা ঠিকই, হিউম ব্যাপারে তার হতাশা লুকিয়ে রাখেননি যে নিজেদের এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য ধনসম্পদ আহরণের লিপ্সা হয়তো বা অন্তহীন, চিরকালীন, সর্বজনীন এবং সমাজের পক্ষে সরাসরি ধ্বংসাত্মক প্রতিপন্ন হতে পারে। আবার ন্যায্যতা-বিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্রেও মানুষ যে প্রায়ই আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়, সে ব্যাপারেও তার হতাশার সীমা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জোর দিয়েই বলছেন যে যুক্তির সাহায্যে মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়টিকে অনুধাবন করতে পারলে সমাজে পরিমিতিবোধ মিতাচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছেন, যেমনভাবে লোকে নৌকার দাঁড় টানে একটা সাধারণ স্বার্থে, সাধারণ রীতি মেনে, সেখানে কোনো প্রতিশ্রুতি বা চুক্তির দরকার পড়ে না, তেমনই লোকেদের ভেতর ন্যায্যতাবোধ গড়ে ওঠে সাহচর্য কথোপকথন থেকে। পারস্পরিক সাহচর্যের মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যবহারিক যুক্তি প্রয়োগ বাড়িয়ে তোলার প্রবল স্বীকৃতি মেলে হিউমের প্রায় ২০০ বছর পর লেখা আন্তনিও গ্রামশির অরডিনে ন্যুভো (L’Ordine Nuovo) প্রবন্ধে। মোদ্দাকথা হলো, সাহচর্যের মধ্য দিয়ে মানুষের যুক্তি প্রয়োগের স্বীকৃতি যুক্তি প্রয়োগের ভূমিকাকে খাটো করে দিচ্ছে না, বরং কীভাবে যুক্তি প্রয়োগ কাজ করে সেটা বুঝতে সাহায্য করছে।

যুক্তি প্রয়োগের চরিত্র নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে আরো একটি ব্যাপার হলো, হিউম যাকে পরীক্ষামূলক যুক্তি প্রয়োগ বলে অভিহিত করছেন, সেই বিষয়টার ওপর তার মনোযোগের ধরন। তার ভাষায়, পরীক্ষামূলক যুক্তি প্রয়োগ...ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে যেমন আছে তেমনি পশুদের মধ্যেও আছে এবং এর ওপর জীবনের সব আচরণ নির্ভর করে। হিউমের মতে, একটা স্তরে এটা সহজাত প্রবৃত্তি বা যান্ত্রিক শক্তির একটা ধরন। কিন্তু পরীক্ষামূলক যুক্তি প্রয়োগ মানে এই নয় যে সেখানে যুক্তি থাকবে না। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলছেন, যে সহজাত প্রবৃত্তি কোনো লোককে আগুনে হাত দেয়া থেকে বিরত রাখে, সেটি যেমন সহজাত প্রবৃত্তি, তেমনি আবার যুক্তি প্রয়োগের একটা ধরনও বটে। আগুনে হাত না দেয়ার সহজাত প্রবৃত্তিটা আসলে আগুনে হাত দিলে কী হয়, সে ব্যাপারটা আমাদের নিজেদের চোখ দিয়ে দেখাএবং অন্যদের কাছ থেকে শেখা দুটো ব্যাপারের সঙ্গেই যুক্ত, এগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটাই হলো পরীক্ষামূলক যুক্তি প্রয়োগ। এই দ্বৈত ভূমিকার মোট ফল হলো যুক্তি প্রয়োগের পরিসরটা প্রসারিত হওয়া এবং এতটাই প্রসারিত হওয়া যে প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হয়ে ওঠে (হিউম তার অব দ্য রিজন অব অ্যানিমেলস প্রবন্ধে বিষয়ে আলোচনা করেছেন) সুতরাং আগুনে হাত না দেয়ার মতো সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা কেবল একটা তাত্ক্ষণিক প্রবৃত্তিতাড়িত ব্যাপার, এতে যুক্তি প্রয়োগের কোনো ভূমিকা নেইএমন কথা বলা যাবে না।

তেমনই নৈতিক যুক্তি প্রয়োগের পরিসর আবশ্যিকভাবেই সীমিত বলে হিউম যে দাবি পেশ করেন, সেটাও এই নির্দিষ্টকরণ প্রক্রিয়ার অংশ। হিউম যেমন বলেছেন, আমরা কখনই পৃথিবীর উত্পত্তি এবং অসীম থেকে অনন্ত পর্যন্ত প্রকৃতির অবস্থান বিষয়ে যে ধারণাই গড়ে তুলি না কেন, সেগুলোর কোনোটা সম্পর্কেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারব না। কিন্তু এটা মেনে নিয়েও যুক্তি প্রয়োগের সাহায্যে যতটা সমাধান বের করা যায়, সেটা করার ব্যাপারে হিউম পিছিয়ে থাকেননি। এটা অবশ্যই বলা যায়, হিউম যুক্তি প্রয়োগের ওপর এতটা জোর দিতেন বলেই তার কালের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে খুব সন্দেহের চোখে দেখত। এখানে একটা কথা বলতেই হবে। আমরা হয়তো আমাদের সব আগ্রহ জিজ্ঞাসার সদুত্তর পাব না বা সব সমস্যার সমাধান করতে পারব না। কিন্তু যতদূর পর্যন্ত জ্ঞানের অনুসন্ধান করা যায় ততদূর পর্যন্ত তা করার কারণ আমাদের আছে।

যুক্তি তখনই কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে যখন নাকি তার দ্বারা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান করা যাবে পূর্বধারণা সমকালীন সিদ্ধান্ত তত্ত্ব (ডিসিশন থিয়োরি) যুক্তিশীল চয়ন তত্ত্বের (থিয়োরি অব র্যাশনাল চয়েস) বিরাট ক্ষতি করেছে। বস্তুত, মানব যুক্তি প্রয়োগের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পৃথিবী সম্পর্কে সুবিন্যস্ত তথ্যের যে অসম্পূর্ণতা আছে তার অনুধাবন। একইভাবে আমাদের কাছে কর্মপ্রণালির বিভিন্ন বিকল্প থাকে। তাদের একটি স্পষ্টঅসম্পূর্ণ হলেওক্রমতালিকা তৈরি করার ব্যাপারটাও যুক্তি প্রয়োগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আধুনিক সামাজিক চয়ন তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আংশিক সমাধানের ওপর নির্ভর করতে শেখার মতো বড় একটি ব্যাপার। দিকটায় হিউমীয় চিন্তার সুস্পষ্ট প্রভাব আছে। যুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সামনে থাকা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারব, তবেই তার কার্যকারিতা প্রমাণ হবেএমন নয়।

আড়াইশ বছরেরও বেশি আগে হিউমের চিন্তায় স্পষ্টভাবে উঠে আসা অনুধাবন কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত তত্ত্বগত বিশ্লেষণে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। আমার মনে হয়, ন্যায্যতা বিষয়ে হবসের চিন্তাটাই প্রাধান্যকারী ভূমিকায় থেকে গেছে। হবসের বক্তব্য, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ছাড়া ন্যায্যতা সম্পর্কে সুসামঞ্জস্যভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। ফলে সমসাময়িক পৃথিবীতে বিশ্বন্যায্যতা নিয়ে কিছু বলাটা অলীক কল্পনামাত্র এটা অন্য একটি ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত: যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ধারণা আমাদের পরিচিত সব রকম অন্যায্যতাকে দূর করতে পারবে ততক্ষণ তাকে ন্যায্যতার ধারণা বলে মেনে নেয়া যাবে না। (হবসের ন্যায্যতাকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের গণ্ডির ভেতর ভাবার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ন্যায্যতা সম্পর্কে ধারণাটিকে সম্পূর্ণ বা যথার্থ হতে হবেসব অন্যায্যতাকে দূর করতে না পারলে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। যেহেতু পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র রয়েছে, তাই তার হয়তো মনে হয়েছিল বিশ্বের সর্বত্র ন্যায্যতার কথা বললে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা আওতার বাইরে চলে যাবে অনুবাদক) এই হয় পুরোটা হবে, নয় কিছুই হবে না দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিলে দুর্ভিক্ষ গণহত্যা প্রতিরোধ বা নারীদের বন্দিত্ব মোচনের মধ্য দিয়ে ন্যায্যতার প্রসার ঘটানো যায় না; ন্যায্যতা তখনই বহাল হতে পারে যখন নাকি বিশ্বজুড়ে একটি কার্যকর সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা বৈশ্বিক ন্যায্যতার জন্য যে যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনগুলো আছে সেগুলো সব মেটাবে। দৃষ্টিকোণটি হিউমের ন্যায্যতার পরিধি ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে ওঠার প্রত্যাশার বিপরীত। অথচ যেসব পরিকীর্ণ অন্যায্যতা আমাদের পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে হিউমের চিন্তা খুবই প্রাসঙ্গিক।

আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে আমাদের দৃষ্টির বৈশ্বিক প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ন্যায্যতার পরিধি প্রসারিত করা, নৈতিকতার চর্চায় জ্ঞানের গুরুত্ব, মানুষের যুক্তি প্রয়োগের বিবিধ রূপ পরিগ্রহ ইত্যাদি যে বিষয়ে হিউম জোর দিয়েছেন, দৃষ্টির বৈশ্বিক প্রসারণে সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। হিউমের সময়কার পৃথিবী এখনকার তুলনায় অনেক কম সংহত ছিল কিন্তু তার মধ্যেই তিনি সমস্যাটাকে যেভাবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেদিক দিয়ে বিচার করলে একটা জিনিস স্পষ্ট ধরা পড়ে: মানুষের স্বতন্ত্র জীবনের কারণে সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন সীমানার মধ্যে (সার্বভৌম ঋণ বিষয়ে চিন্তা করা হোক বা না হোক) ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজটা আদৌ যথেষ্ট নয়প্রয়োজনটা এক্ষেত্রে অনেক বেশি  জোরদার। তার বন্ধু অ্যাডাম স্মিথের মতোই হিউমও সমসাময়িক নৈতিক চিন্তাচেতনাকে কীভাবে প্রশস্ত করা যায়, তা নিয়ে খুবই ভাবিত ছিলেন। আজও কাজটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অন্যদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যতই বিস্তৃত হচ্ছে, ন্যায্যতার অনুধাবনটিকে প্রশস্ততর করে তোলার প্রয়োজনটিও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়ে হিউমের চিন্তার নানা রকম প্রভাব আছে। দ্রুত প্রসারিত হয়ে চলা আর্থিক বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন বিশ্ব-নৈতিকতার সন্ধানে যে বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলন চলছে, সেটিকে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে হিউম বর্ণিত যুক্তিভিত্তিক নৈতিকতা এবং সংবেদনের অগ্রগতি মধ্যকার সংযোগের ধারণা খুবই কাজে লাগতে পারে (অবশ্য বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনের নামটাকে খুব যথাযথ বলা যাবে না, কারণ আন্দোলন নিজেই বিশ্বায়িত) বিশ্বজোড়া ব্যাপক অসাম্য নিয়ে, বিশেষত সব চেয়ে বঞ্চিত মানুষদের জীবন নিয়ে দেশে দেশে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। ক্ষোভ পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে নানা দেশের মানুষের প্রতিবাদী সমাবেশের মধ্যে ভাষা পাচ্ছে, প্রায়ই খুব অমার্জিতভাবে। বিক্ষোভগুলোয় উচ্চারিত স্লোগানগুলো অতি সরলীকৃত এবং প্রতিবাদগুলো বিশৃঙ্খল হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে ঘটে চলা এসব বিরোধিতাকে কিন্তু অধিকতর বৈশ্বিক ন্যায্যতার দাবি হিসেবে অনুভব করা যায় এবং তাকে হিউমের প্রত্যাশিত মানবসংবেদনের স্বাভাবিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা যায়। এভাবে দেখতে পারলে বিশ্বায়নবিরোধী এই বিরাট আন্দোলনটির একটি বড় অংশের অন্তর্নিহিত নৈতিকতার দিকটা বোঝা সহজ হয়।

হিউম প্রায়োগিক জ্ঞান, বিশেষত কোনটা কাজ করছে আর কোনটা করছে না, সেই অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন (এটি আমাদের সময়কার উন্নয়ন অর্থনীতির একটি প্রধান ব্যাপার) অধিকতর ন্যায্য একটি পৃথিবীর দিকে এগোনোর চেষ্টায় আমরা হিউমের দিকনির্দেশ থেকে লাভবান হতে পারি। এটি কেবল বিভিন্ন রকমের সাহায্য সহায়তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, অর্থনীতিক প্রগতিসহ উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে শিক্ষা স্বাস্থ্যের ভূমিকা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। বাজার অর্থব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা কী কী অর্জন করতে পারে বা পারে না, সেসবের মূল্যায়নেও প্রায়োগিক অনুধাবন খুবই কাজে লাগে। বাজার কখনো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে না বিশুদ্ধ তত্ত্বটি ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অন্তত অংশত দায়ী। বাজার প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কাজ করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি, সে সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানের গুরুত্ব কতখানি, তা ঘটনা থেকে জোরালোভাবে উঠে আসে।

দূরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে, ন্যায্যতার পরিধি তত প্রসারিত হবেহিউমের দিকনির্দেশক চিন্তাটির প্রভাব বর্তমান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পারস্পরিক সম্পর্কে নিহিত নৈতিকতার ওপরেও ভালোভাবে পড়ছে। বিশেষ করে আমাদের আজকের পরিবেশবিষয়ক আচরণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে একটি পরিষ্কার অনুধাবনের ব্যাপারে হিউমের চিন্তা খুবই কার্যকর। পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণেধরা যাক লাগাম ছাড়া পরমাণু শক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়েভবিষ্যৎ পৃথিবীর বাসিন্দাদের জীবন সমস্যাসংকুলতা সম্পর্কে আমরা যত বেশি করে জানতে পারব, জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাবে, ন্যায্যতার পরিধি প্রসারিত করে তোলার দাবিটাও তত বেশি জোর পাবে। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জ্ঞানতত্ত্বের গুরুত্ব আগে এত জোরালোভাবে উঠে আসেনি। এর উদাহরণ হিসেবে আমরা নিতে পারি বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং তার পেছনে মানুষের আচরণ কতখানি দায়ী, -সম্পর্কিত সাম্প্রতিক আলোচনাগুলোর কথা, যা এর আগে শোনা যেত না। সমকালীন পৃথিবীতে অর্থনীতির কার্যকারণ সূত্র থেকে পরিবেশগত অবক্ষয় পর্যন্ত ন্যায্যতা সম্পর্কিত নানা বিষয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞানের অনুসন্ধান কিছুটা বিপদের মুখে পড়েছে এবং সে কারণে দিকটিতে জোর দেয়ার বিশেষ কারণ আছে।

আমাদের পৃথিবী আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কতগুলো জিনিসের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে আমাদের অনুধাবনের ওপর: আমরা কতটুকু জানি, আমরা যুক্তিযুক্তভাবে কী আশা করতে পারি, আমাদের অনুভূতিতে কী ধরা পড়ছে, কোন বিষয়গুলোকে আমাদের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে, আমাদের যুক্তি প্রয়োগ কত বিভিন্নভাবে হতে পারে এবং ন্যায্যতা অন্যায্যতা সম্পর্কে আমরা কীভাবে চিন্তা করবএগুলোর মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে আমরা কতখানি বুঝে উঠতে পারছি তার ওপর। মুহূর্তে এগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর প্রায় কিছুই নেইহিউমের নিজের কালের তুলনায়ও এগুলোর আপেক্ষিক গুরুত্ব কিছুমাত্র কমেনি। [শেষ]

 

অমর্ত্য সেন: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী, বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটি প্রফেসর

দ্য নিউ রিপাবলিক থেকে ভাষান্তরআহমেদ জাভেদ

সভাপতি, বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন