অভিমত

শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঋণ প্রয়োজন

মো. রিফাত-উর-রহমান

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শুধু ক্লাসরুমের পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে ক্লাসরুমের গণ্ডির বাইরেও অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিজীবনের সমস্যাগুলো শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করে, যার মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়ার সুযোগ ঘটে। সুইডেনের পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে পাঁচ বছর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ধনীদের সন্তানদের জন্য। আমার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা তা বলে না। বরং, অভিজ্ঞতা বলছে, প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এদের অনেকেই প্রাইভেট টিউশনি, ফাস্ট ফুডের দোকান কিংবা শপিং স্টোরগুলোতে পার্ট টাইম কাজ করে তাদের টিউশন ফির অর্থ জোগাড় করত।

তিন বছর ধরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। তিন বছরের অভিজ্ঞতায় জেনেছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশনি করে একদিকে নিজের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করে, অন্যদিকে অনেকেই তাদের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে অসচ্ছল পিতা-মাতাকে সহযোগিতা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। করোনা প্যানডেমিকের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রম শারীরিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থী তাদের নিজ বাড়িতে চলে গেছে। ফলে তারা তাদের পার্ট টাইম কাজের সুযোগ হারিয়েছে। তারা কবে ক্লাসে ফিরতে পারবে আমরা কেউই জানি না।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এদের কারণেই এত বিশাল আয়োজন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা কি কোনো মাস্টারপ্ল্যান করতে পেরেছি? টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কেউ পিছিয়ে থাকবে না আদর্শের নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটা টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এক্ষেত্রে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসরণ করা সম্ভব না হলেও অন্তত এশিয়া মহাদেশের কিছু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর মডেলগুলো পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো তাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি কিংবা পড়াশোনা সম্পর্কিত আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় সেগুলোর ওপর বিস্তর গবেষণা করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এসব গবেষণার ফলাফলের আলোকে এবং আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সময়োপযোগী, সুপরিকল্পিত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যে চাপগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কিংবা সেমিস্টারের ফি দেয়ার চাপ, বিশেষত যারা নিজেরা অর্থ উপার্জন করে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করে; অভিভাবকদের স্বপ্ন পূরণের চাপ; সর্বোপরি যে বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করছে সে বিষয়কে পরবর্তী পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারবে কিনা এবং পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাবে কিনা ইত্যাদি নানা ধরনের জটিলতায় আচ্ছন্ন থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষার্থী এতগুলো চাপ মোকাবেলা করবে নাকি শিক্ষা-গবেষণায় মনোনিবেশ করবে? পৃথিবীর সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যৌথভাবে গবেষণার কাজ করে। আমরা আমাদের দেশে কতজন শিক্ষার্থীকে অধ্যয়নকালীন গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আগ্রহবোধ সৃষ্টি করতে পেরেছি?

যে বিষয়গুলো তাত্ত্বিক চর্চা ছাড়াও প্রায়োগিক চর্চার মাধ্যমে অধ্যয়ন করতে হয়, সেসব বিষয়ে প্রায়োগিক চর্চার জন্য শিক্ষার্থীদের গবেষণার উপকরণ কিনতে হয়। একটি মাঠকর্ম সম্পাদন করার পরও তার প্রতিবেদন মানসম্মতভাবে জমা দেয়ার জন্য একটা ভালো অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়। একজন শিক্ষার্থী তার অধ্যয়নের খরচ জোগাতেই যেখানে হিমশিম খায়, সেখানে সে তার প্রায়োগিক চর্চায় কতটুকু মনোযোগ দিতে পারবে? একই সঙ্গে যারা নিজের পার্ট টাইমের উপার্জন দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করে, তারা টিকে থাকার কথা ভাববে নাকি তার বিষয়ভিত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে মনোযোগী হবে?

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি শুধু কয়েকটি অক্ষর নয়। শব্দের সামনে বিশ্ব শব্দটি রাখার কারণ হলো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পরিচয় হবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। আমরা এরই মধ্যে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে ফেলেছি। বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে অবশ্যই বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সবার আগে নিশ্চিত করা দরকার বৈশ্বিক মান এই মান ঠিক না রেখে অপরিকল্পিতভাবে শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি করে আমরা কোন উদ্দেশ্যগুলোকে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করছি? আমাদের উদ্দেশ্য কি শুধু সংখ্যাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা?

টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এখনো আমাদের ভাবার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যেন নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে তার শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে তার রোডম্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নামমাত্র সুদে শিক্ষাঋণ পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। শর্ত থাকবে যে শিক্ষার্থী তার কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর থেকে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। শিক্ষা খাত এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বিনিয়োগ করলে এবং ভর্তুকি দিলে তার ফলাফল নেতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ। আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঋণ প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নিন। একদিন আমাদের শিক্ষার্থীরাই দেশটাকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে তাদের মেধা শ্রম কাজে লাগাতে সক্ষম হবে।

 

মো. রিফাত-উর-রহমান: শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন