স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হোক

করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় আবারো স্কুল-কলেজ খোলার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। টানা ১৫ মাস বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সময়ে সরকারের প্রচেষ্টা ছিল না, তা- নয়। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাই সঠিকভাবে গ্রহণ করা যায়নি করোনা সংক্রমণ ওঠানামার কারণে। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। সংকট শুধু একা বাংলাদেশের ছিল না। বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশকেই এটি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জুন থেকেই স্কুল-কলেজ খুলতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। লক্ষ্যে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে -যাবৎ কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। মাউশির পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা মানসিকভাবে তৈরি হয়ে আছি। সরকার স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দিলেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে। স্কুল-কলেজ খোলার উদ্যোগটি শুভ। তবে বিদ্যালয়গুলোয় স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পরিপালনও নিশ্চিত করতে হবে।

করোনা যে সহজে বিদায় নিচ্ছে না, তা মোটামুটি অনুমেয়। জাতিসংঘও বলছে, মৌসুমি রোগ হিসেবে এটি পৃথিবীতে বিরাজ করতে পারে। বিশ্বের অংশ হিসেবে তাই সারা বছর বাংলাদেশে অল্পবিস্তর করোনা রোগী থাকা অনেকটা স্বাভাবিক। আর তা- যদি হয়, তাহলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ থাকবে? তা নিশ্চয়ই নয়। পুরো এক বছরের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের অর্থনৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষতি নীতিনির্ধারকদের তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে দাবি করা যাবে না। কেননা শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। জিডিপির ভিত্তিতে ক্ষতির হিসাব করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণও পাওয়া যাবে না। কারণ কিছু কিন্ডারগার্টেন ছাড়া আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিসহ অন্যান্য লেনদেন যথারীতি করোনাপূর্ব অবস্থায় আছে। করোনার কারণে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা সব অঞ্চলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সরকারগুলোকে। যদিও অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলো একপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বাড়ি থেকেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। তবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেই পড়াশোনায় শিক্ষার সামগ্রিক অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। আবার তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে সেই সুবিধাটুকুও কাজে লাগানো সম্ভব নয়।

করোনা মহামারীর মধ্যে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে বেশির ভাগ দেশ রক্ষণাত্মক কৌশলে এগোচ্ছে। এতদিন মূলত সংক্রমণ কমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আবার করোনা সংক্রমণের হার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জাপানের স্কুলগুলো অনেক আগেই খুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা, খোলা জানালার শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখে মাস্ক পরা ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়া হয়। নরওয়েতে গত বছরের এপ্রিল থেকে কিন্ডারগার্টেন খুলে দেয়ার ঘোষণা আসে। তাদের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, শ্রেণীকক্ষে ১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে না রাখা, ডেস্কগুলো নিয়মিত ধোয়া ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সে প্রিস্কুল, এলিমেন্টরি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয় গত বছরই। ক্লাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসা এবং অন্যান্য সুরক্ষব্যবস্থা মেনে চলা হয়। থাইল্যান্ডে জুলাইয়ে খুলে দেয়া হয়েছে স্কুল। তাপমাত্রা পরীক্ষা বা দুই ডেস্কের মাঝে পার্টিশন ব্যবহার করে ক্লাস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আমাদেরও স্কুল-কলেজ খোলার পর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়বে। আমাদের আশু প্রয়োজনের কথা ভাবতে হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষার গতি ফিরিয়ে আনার জন্য পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে মুহূর্তে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়াটাই হবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে করোনা যদি আবার ফিরে আসে, তৃতীয় ঢেউয়ের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার প্রাদুর্ভাব যদি ভয়ংকর হয়, তখন আবার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিতে হবে।

করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষাই আমাদের এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর শিক্ষার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে এখন দূরশিক্ষণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ইরানেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে প্রধানত জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শাদ নামে একটি লার্নিং অ্যাপ চালু করেছে। অ্যাপে সব শিক্ষার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে তারা অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। দূরশিক্ষণের আওতায় অসংখ্য শিক্ষাবিষয়ক অ্যাপস আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দিয়ে খুব সহজে লকডাউনে থেকেও বাড়িতে বসে শিক্ষা প্রদান গ্রহণ করা যায়। অন্তত একটি শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা সুবিধার আওতায় আসতে পারে। আমাদের দেশে দরিদ্র পরিবার অনেক। সেসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেই সরকারকে পুরো পরিকল্পনা সাজাতে হবে। স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে সপ্তাহে নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য দু-তিনদিন করে ক্লাস চালু রাখা যেতে পারে। এভাবে একই সময়ে প্রচুর জনসমাগম এড়ানো সম্ভব। অধ্যায়ভেদে অনলাইন-অফলাইন সমন্বয় করা যেতে পারে। এভাবে আগের মতো শতভাগ ক্লাস নিতে না পারলেও পরবর্তী শ্রেণীতে ওঠার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর সরাসরি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান সম্ভব।

স্কুল খোলার আগে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গাইডলাইন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাধ্যমিক প্রাথমিক স্কুলের গাইডলাইন হবে আলাদা। কারণ প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবস্থাপনা এক হবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ টিম গঠন করা উচিত। শিক্ষার্থীরা কীভাবে আসবে, স্কুলে প্রবেশের সময় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, তাদের বসার ব্যবস্থা প্রভৃতি প্রণীত গাইডলাইন অনুযায়ী চূড়ান্ত করতে হবে। ধাপে ধাপে স্কুল খোলা কলেজ খোলা যেতে পারে। সংক্রমণের হার পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে এলাকায় সংক্রমণের হার সর্বনিম্ন, সেখানকার স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে তদারকি জারি রাখতে হবে, যাতে সংক্রমণ বেড়ে উঠলে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ফলে সেখানে আরো সময় নিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে স্কুল-কলেজ খুলতে হবে। তাছাড়া কোনো এলাকায় স্কুল-কলেজ খোলার পর করোনার সংক্রমণ বেড়ে উঠলে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের মতো এলাকাভিত্তিক বিদ্যালয় চালু রাখা যেতে পারে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হ্রাসে ক্লাসের সংখ্যা হ্রাস এবং একাধিক শিফট চালু করা যেতে পারে। আবার যেখানে শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে যেসব স্কুল কলেজে দূরশিক্ষণ বা অনলাইনে পাঠদান করতে সক্ষম এবং তাতে ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে সেগুলো না খোলাই শ্রেয়। এভাবে ঝুঁকি পর্যালোচনাপূর্বক এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভালো ফল মিলবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ প্রক্রিয়াই অনুসরণ করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন