অভিমত

স্বতন্ত্র নীতির আলোকে উচ্চশিক্ষা পরিচালনা করতে হবে

ড. আশেক মাহমুদ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবের নিয়োগ অনুমোদিত হয়। নিয়ে সর্বমহলে তোলপাড় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।  সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারি, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি। ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত হলেও আমাদের বোঝা দরকার, কেন ধরনের আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের মধ্যে পড়তে হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ, নিন্দা, আলোচনা, সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবাদের বয়ান হলো, এটা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের সংকট, যে সংকটে শিক্ষা গবেষণা আরো ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন হুমকির মধ্যে পড়বে। নিন্দার বয়ান হলো, এত দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত মর্যাদার যে স্বপ্ন বুনেছিলাম, সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলল, অনতিবিলম্বে এই অপচেষ্টার তিরোহিত করা হোক। এদিকে সমালোচনার বচন হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেই এর দায় নিতে হবে, কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি এখন সবারই জানা, যে দুর্নীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেখতে হবে সমস্যাটা আসলে কোথায়।

সমস্যাকে আমরা তিন দিক থেকে দেখতে পারি। এক. আইনগত দিক, দুই. কাঠামোগত দিক, তিন. সমন্বয় সম্পর্কিত দিক।   

. আইনগত দিক: আমরা জানি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এক. স্বায়ত্তশাসিত, দুই. সরকারি। বিভাজনের মধ্যেই সংকটের বীজ রোপণ করা হয়। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পায়। কিন্তু অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ঘোষিত হলেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্ব স্ব আইনে চলার অধিকারপ্রাপ্ত হয়। সমস্যা হলো, সরকারি নামে ঘোষিত হওয়ার ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংযুক্তি চলে আসে। কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিবের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে নিয়োগ অনুমোদিত হয়। অনুমোদনের আইনগত ভিত্তি হিসেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ১৩ নং ধারার নং উপধারাকে কাজে লাগানো হয়।

ধারায় বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর, তত্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে বৎসর মেয়াদের জন্য একজন কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করিবেন। ধারা দেখিয়ে বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপক যে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন, এমন কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়নি। সে সুবাদে একজন অভিজ্ঞ সচিবকে দায়িত্ব দিতে আইনগত বাধা নেই। এমন যুক্তিতে বলা হয়, নিয়োগের প্রক্রিয়াটি বৈধতার সংকট তৈরি করছে না। তাই বলে একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব যে দায়িত্ব পাবেন, তারও আইনগত স্পষ্টতা নেই। ধরনের অস্পষ্টতা ইচ্ছা করেই জিইয়ে রাখা হয়। তাহলে সংকট কোথায়? সংকট অনুপ্রবেশের অনধিকার চর্চা থেকে উদ্ভূত। কৌশলগতভাবেই ধরনের ধারা-উপধারা তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে যে আমলাদের যোগসাজশ আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আইনই কি একমাত্র মাপকাঠি? আইনি প্রক্রিয়ার ভিত্তি যদি নৈতিকতা প্রজ্ঞা না হয়, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। কারণে আইনের ধারা পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

. কাঠামোগত দিক: আইনগত দিকের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রশ্নের সম্মুখীন। ধরনের সমালোচনার মোদ্দাকথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার সঙ্গে হয় না বলে দুর্নীতির মধ্যে অনেকেই জড়িয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নৈতিকতার শিক্ষণ প্রক্রিয়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সে কারণে নীতিমানদের ক্ষমতায়ন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রশাসনিকএই দুই কেন্দ্রীয় জায়গায় সুসমন্বয় হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সমন্বয় কীভাবে করা যায়, সেদিকে চিন্তা না করে প্রশাসনিক জায়গাকে আমলাতান্ত্রিক করার চিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিকতাকেই বিনষ্ট করবে।

সেদিক বিবেচনা না করে কেউ কেউ এও বলে থাকেন, যারা হিসাব-কিতাব ভালো বোঝেন, নিয়মকানুন ভালো জানেন, এমন মানুষদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেয়া উচিত। ধারণা আত্মঘাতী ধারণা। যুক্তি কী? তাদের যুক্তি হলো, শিক্ষকরা ক্লাস নেবেন আর আমলারা প্রশাসন চালাবেন। তারা নাকি হিসাবকিতাব ভালো বোঝেন!! মনে হচ্ছে শিক্ষকরা হিসাবকিতাব বোঝেন না, নিয়মকানুন বোঝেন না। তাছাড়া পদগুলো কি হিসাবকিতাবের আর নিয়মকানুনের? এখানেই আমাদের একাডেমিক জায়গাটা বোঝার ঘাটতি।  

তাহলে কি হিসাবনিকাশ আর নিয়মকানুন জারি রাখার জন্য সচিবকে নিয়োগ দিতে হবে? চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস যিনি ভালো বোঝেন, তিনি তো হিসাবনিকাশ আরো ভালো বোঝেন। একজন অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসাব ভালো বুঝবেন না? আর আইনকানুনের কথা যদি বলি, আইন বিভাগের শিক্ষক কি আইন ভালো বোঝেন না? যেখানে একজন ট্রেজারারকে নিয়োগ বোর্ডে রাখা হয়, সেখানে ট্রেজারার যদি শিক্ষক থেকে না হন, তাহলে কীভাবে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের কাজটা সমাধা হবে? নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বচ্ছতার ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। তাই বলে সেই ঘাটতি কি বাইরের কেউ পূরণ করতে পারবেন? একজন একাডেমিশিয়ান কি ভালো পরিকল্পনা করতে পারেন না? এজন্য নন-একাডেমিশিয়ানের নিয়োগ কি সমস্যাকে আরো বাড়াতে পারে না

. সমন্বয় সম্পর্কিত: আসলে একাডেমিক আর প্রশাসনিক দুটোকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাইল ডুরখেইমের অর্গানিক সলিডারিটির জায়গা থেকে যদি বলি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান, ডিন, ট্রেজারার, ভিসি, প্রোভিসি মহোদয় সবারই আলাদা আলাদা দায়িত্বের জায়গা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকের কাজের সমন্বয় না হলে সলিডারিটি বা সংহতি আসবে না। প্রত্যেকের কাজের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। সেই আন্তঃসম্পর্ক সুনিপুণ হবে তখনই, যখন পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ পদ্ধতির দক্ষতাকে সমাজবিজ্ঞানী হেবারমাস নাম দিয়েছেন communicative competence এর মানে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্ররূপে চলতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা আস্থা দিয়ে পরিশীলিত করতে হবে। কাজ করতে হলে একই প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতর এজেন্সির ক্ষমতায়ন দরকার।

এটা কিছুতেই মনে করা ঠিক হবে না যে শিক্ষকের কাজ ক্লাস আর গবেষণায় সীমাবদ্ধ। শিক্ষকদের শিক্ষার প্রায়োগিক দিক থাকতে হয়। এন্থনি গিডেন্স একজন সমাজবিজ্ঞানী, অথচ তিনি ছিলেন ব্রিটেন সরকারের একজন উপদেষ্টা। প্লেটোর তত্ত্ব বলে দিচ্ছে একজন দার্শনিক একটা দেশের শাসক হওয়ার জন্য সর্বাধিক যোগ্য। এর সমর্থনে জার্মান দার্শনিক কার্ল জেসপার (১৯৬০) বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণায় চলবে রাষ্ট্র সমাজ, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাতন্ত্র্য আছে। কার্ল জেসপার সরাসরি উল্লেখ করেন, The university must be free because it acts as an intellectual conscience to the state; as such it is not a political tool but, because it speaks from a basis of knowledge,...It controls the state through the power of truth not of force’ (Jaspers, 1960, p. 135).

এর মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো মুক্ত চেতনায় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান নির্মাণ করা, যা কিছুতেই রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হতে না পারে। বরং বিশ্ববিদ্যালয় যে সত্য হাজির করবে তা দিয়েই রাষ্ট্র চলবে, কোনো শক্তি বা ক্ষমতা দিয়ে নয়। এমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান জ্ঞানগত কাঠামোর স্বাধীন প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে।

স্বাধীনতার সেই জায়গা থেকে আমাদের প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে একাডেমিক প্রশাসনিক দুই জায়গার মধ্যে সেতুবন্ধ জরুরি। আমরা জানি, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে দেয়া হয় কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ। তাই যদি হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় নন-একাডেমিশিয়ান কাউকে নিয়োগের প্রয়োজন থাকে না। একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকও হতে পারেন ট্রেজারার বা রেজিস্ট্রার।

একজন সৎ যোগ্য একাডেমিশিয়ানকে কীভাবে প্রশাসনিক পদে আসীন করা যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতেই হবে। কেননা তাদের কাজ হলো একাডেমিক কাজকে গতিশীল করা। একাডেমিক কাজ গতিশীল করতে হলে এই পদাধিকারী এজেন্সিকে বুঝতে হবে একাডেমিক কাজের মান, গতিপ্রকৃতি। 

কোন ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা বুদ্ধিবৃত্তিকনিছক হিসাবের কাজ নয়। একাডেমিশিয়ান না হলে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় সমন্বয় করা, সমঝোতায় পৌঁছা কঠিন। তাছাড়া ধরনের প্রতিষ্ঠানে একজন সচিব না, নন-একাডেমিশিয়ানের অন্তর্ভুক্তি একাডেমিক সংহতিতে ফাটল ধরাবে, এটাই স্বাভাবিক। সৃষ্টি করতে পারে কর্তৃত্বের আবহ, বিঘ্নিত হতে পারে যোগাযোগের সমন্বয় (distorted communication) আর নৈতিকতার জায়গা থেকে যদি বলি, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠান চালাতে পারে তাহলে দুর্নীতির যে বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি, তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। আমরা চাই না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আমলাতন্ত্রের ছকে পরিচালিত হোক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে রক্ষা করা যায়, নিয়ে কার্যকরী কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা প্রণয়ন আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

আমরা চাই নন-একাডেমিশিয়ানের নিয়োগ যেন বাতিল করা হয়। সততা, ন্যায় স্বতন্ত্র নীতির আলোকে আমাদের উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হোক প্রত্যাশা আমাদের সবার।

 

. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন