ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে মন্ত্রিসভার অনুমোদন

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বিধান

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গতকালই সংশোধিত আইনটির খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সংশোধনীর খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা স্পষ্ট করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ও কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান আইনটি প্রণয়নের পরের কয়েক দশকে দেশের ব্যাংক খাতের প্রসার ও পরিধি বেড়েছে। অন্যদিকে খাতটিও এখন সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত। নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে বিতরণকৃত ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। আবার আইনটিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা না থাকায় অনেকেই এর ফায়দা তুলেছে বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগও উঠেছে। ফলে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। গোটা ব্যাংক খাতেই এখন নড়বড়ে দশা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকেব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২১’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন।

বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে কর্মরত ব্যাংক কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর মোট সংখ্যা, মোট সম্পদ, আমানত, ঋণ, লিজ, বিনিয়োগ বাড়ায় সবকিছু ওই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা, তদারকি, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দেশের আর্থিক খাতের সুশাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য আইনটি করা প্রয়োজন ছিল। সেজন্য এ সংশোধনী আনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ব্যাংক কোম্পানি আইনসংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে আইনের সংশোধনী খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো হলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিষয়টি আগের আইনে অতটা স্পষ্ট ছিল না। কারণ আইনটি করা হয়েছিল ১৯৯১ সালের প্রেক্ষাপটে। নতুন আইনে সেটা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী গৃহীত ঋণ, বিনিয়োগ, অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ, সুদ অথবা মুনাফা পরিশোধ করেন না, তাদেরই আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। এছাড়া কেউ ঋণের বিপরীতে দেয়া জামানত ঋণদাতা ব্যাংক কোম্পানির লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া হস্তান্তর বা স্থানান্তর করলেও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন বলে খসড়ায় বিধান রাখা হয়েছে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়ে নতুন আইনের বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হওয়া ঋণগ্রহীতাকে দুই মাস সময় দিয়ে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত চেয়ে নোটিস দেবে। এ সময়ের মধ্যে ঋণগ্রহীতা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অনতিবিলম্বে অর্থঋণ আদালত আইনের বিধান অনুযায়ী বন্ধকীকৃত সম্পত্তির নিলাম আয়োজন করবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিলামে তোলার পাশাপাশি সম্পত্তির দখল নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তাদের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, খসড়ায় দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার-সংক্রান্ত নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এতে ব্যাংক কোম্পানির সংকটাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আছে। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের বিধানও এতে রাখা হয়েছে।

খসড়া আইনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে জানিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের পরিচালক বা যেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকবে, তাকেই বড় জরিমানা দিতে হবে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও চলবে। এটা আজকের বৈঠকে বিশেষভাবে তোলা হয়েছে। কারো ১ কোটি টাকা জরিমানা হলে তিনি জরিমানা দিয়ে বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু যদি ১০ বা ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন, সেজন্য পেনাল কোডের আইনও তার জন্য প্রযোজ্য হবে। তার যে জরিমানা হলো সেটা ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের পথে কোনো বাধা হবে না।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সংশোধিত আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে যেসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে সেটা ভালো। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের ব্যাংক খাতে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে দেখতে হবে এগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংককে পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের বিধান রাখার বিষয়টিকেও সাধুবাদ জানান তিনি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের শনাক্ত ও চূড়ান্ত করার বিষয়ে খসড়া আইনের ২৭ ধারার উপধারায় বলা হয়েছে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি শনাক্তকারী কমিটি ও একটি চূড়ান্তকারী কমিটি গঠন করবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সময় সময়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। এ তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক আবার দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে। চূড়ান্তকরণ কমিটি থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চূড়ান্তভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

সংশোধিত আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাতে পারবে। এ ধরনের ঋণখেলাপিদের ওপর বিদেশযাত্রা, গাড়ি ও বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাওয়া বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এছাড়া তারা কোনো পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনাকারী কমিটির কোনো পদেও থাকতে পারবেন না।

এছাড়া খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ার ওপরও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সময়সীমা (পাঁচ বছরের বেশি হবে না) অতিবাহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। এছাড়া কোনো ব্যাংকের পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে।

তবে ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যাংকাররা মনে করছেন, খসড়া আইনে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, প্রস্তাবিত ব্যাংক কোম্পানি আইনটির খসড়ার বিষয়ে আমরা অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব ও গভর্নরের কাছে লিখিত মতামত দিয়েছিলাম। মন্ত্রিসভায় আজ আইনটির যে খসড়া নীতিগত অনুমোদন পেল, লক্ষ করছি সেখানে আমাদের মতামতের প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। অনুমোদিত খসড়াটির সামগ্রিক মূল্যায়নে আমরা কাজ করছি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আইনের খসড়ায় একটি ধারা আছে, যা অনুসরণে মামলা বা চার্জশিট আছে এমন কোনো ব্যক্তি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পারবেন না। যেহেতু আমাদের দেশে আইনি প্রক্রিয়ার হয়রানিমূলক ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, সেক্ষেত্রে এ ধারার ব্যবহার অনেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে কেবল দণ্ডিত হলেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের ক্ষেত্রে বাধা থাকা উচিত বলে মনে করি। অনুমোদিত খসড়াটির সার্বিক পর্যবেক্ষণ চলছে, এবিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামত জানানো হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন