কভিড-১৯ স্বাস্থ্যকর্মী

প্রণোদনার প্রতিশ্রুত অর্থ এখনো অধরা

আল ফাতাহ মামুন

গত বছর মার্চে দেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পর দ্রুত কয়েকটি হাসপাতালকে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়। সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হয় কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যাও। গত এপ্রিলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়া চিকিৎসাকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনা দেবে সরকার। সে ঘোষণার বছর পেরিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রণোদনা পাননি সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ নার্স, চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই অর্থ বরাদ্দ পেতে দেরি হচ্ছে।

কভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য অন্যতম হাসপাতাল হলো কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। প্রথম ঢেউয়ের মতো করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও জরুরি চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে হাসপাতালটি। কথা হয় সেখানে কর্মরত নার্স সাদেকার সঙ্গে। শুরু থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। বণিক বার্তাকে নার্স জানালেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত বছর নিজে কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার সূত্রে পরিবারের ছোট-বড় সবাই একে একে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনিসহ হাসপাতালটির অন্তত ৫০ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর পরও কোনো নার্স রোগীদের সেবা দিতে পিছপা হননি বলে দাবি করেন সেবিকা। কিন্তু এর পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রণোদনা পাননি বলে জানান। অথচ গত বছর প্রণোদনা স্বাস্থ্যবীমাসহ নানা ধরনের সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

কোনো নার্সই প্রণোদনার টাকার কথা ভেবে সেবা দেয় না উল্লেখ করে স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, একজন রোগী ভর্তি হওয়ার পর মূল কাজগুলো কিন্তু আমাদেরই করতে হয়। শুরু থেকেই আমরা নিয়মিত দায়িত্বই পালন করছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী যদি আমাদের কাজের স্বীকৃতিটুকু দেয়া হতো, তাহলে আরো উদ্যমের সঙ্গে কাজ করতে পারতাম।

গত বছরের এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, মার্চ থেকে যারা কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছেন, সরকার তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেবে। এছাড়া দায়িত্ব পালনের সময় কেউ কভিড-১৯- আক্রান্ত হলে তাদের জন্য -১০ লাখ টাকার একটি স্বাস্থ্যবীমা থাকবে। কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবীমার পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি হবে।

ঘোষণার এক বছর পেরিয়ে গেলেও করোনাযুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধাদের একটি বড় অংশই প্রণোদনার অর্থ পাননি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন কয়েকজন নার্স।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স আমেনা খাতুন (ছদ্মনাম) বণিক বার্তাকে বলেন, আজ ১৪ দিন আমি কভিডে আক্রান্ত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা ডিউটি করেছি। আশা ছিল অন্তত ঈদের আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ পাব। কিন্তু সেটা আর হলো না। একই হাসপাতালে আরেকজন সিনিয়র নার্স রাশেদা বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৩৮২ জন নার্স আছেন। এখন পর্যন্ত ১০০ জনের বেশি নার্স কভিড পজিটিভ হয়েছেন। করোনা সংক্রমণের চূড়ান্ত সময়েও আমরা অমানুষিক খাটুনি খেটে দায়িত্ব পালন করেছি। অনেক নার্সকেই অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। পরিবারের চেয়ে পেশাকে প্রাধান্য দিয়েছি আমরা। আমাদের থেকে পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও এখনো বিশেষ প্রণোদনার কোনো অর্থ পাইনি।

তবে সর্বশেষ গতকাল তারা জানতে পেরেছেন যে প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে টাকা কবে হাতে পাওয়া যাবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাজেট শাখা জানিয়েছে, গত মাসে দেশের ২২টি হাসপাতালের কভিড রোগীদের সেবা দেয়া হাজার ৬৭৯ জন নার্স দুই মাসের বিশেষ সম্মানী বাবদ ১৫ কোটি লাখ ১২ হাজার ৩৫০ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। ছাড়াও এপ্রিলেই আরো ১৪টি হাসপাতালের চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা বাবদ ১৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৯০২ টাকা অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মার্চে আরো ১৪টি হাসপাতালের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। কাগজে-কলমে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও সারা দেশে হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া অন্যদের কাছে পৌঁছেনি প্রণোদনার অর্থ। ঘোষণার এক বছর পরও অর্থ না পাওয়ায় স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত প্রায় সবার মাঝেই হতাশা দেখা গেছে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতিকেই দায়ী করছেন তারা।

প্রসঙ্গে স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের মহাসচিব ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. সবুজ বণিক বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালের কোনো নার্স প্রণোদনার একটি টাকাও পায়নি। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন হাজার ৭৫০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃতদের মধ্যে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের কেবল দুজন নার্সের পরিবার ৩৭ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। বাকিরা এখনো পাননি। তিনি বলেন, মৃতদের পরিবারের হাতে টাকা তুলে দেয়ার ব্যাপারে জোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু আক্রান্ত নার্সদের বেলায় বিশেষ প্যাকেজ দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যাপারটি এখনো বেশি দূর এগোয়নি। তবে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, তাই দেরিতে হলেও প্রণোদনার টাকা পাবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন নার্স নেতা।

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনরে সমন্বয়ক নোয়াখালী জেলা হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাস বণিক বার্তাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত করোনাযোদ্ধাদের বিশেষ প্রণোদনার জন্য বারবার আমাদের থেকে চিকিৎসক-নার্সদের তালিকা নেয়া হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ আমরা পাইনি। এমনকি যেসব হাসপতালের নামে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, সেখানকার চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরাও যথাযথভাবে প্রণোদনার অর্থ পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, সারা দেশে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল আছে ১৫২টি। এর মধ্যে মাত্র ১৪টি হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি করোনা হাসপাতালের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনার কোনো ঘোষণা এখনো দেয়া হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রণোদনার আওতায় আসেনি। ছাড়াও বেসরকারি ক্লিনিকেও চিকিৎসক-নার্সরা করোনার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। তারাও প্রণোদনার জন্য মনোনীত নয়। ধরনের বৈষ্যম্য দূর হওয়া দরকার।

করোনার সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা কেন এখনো শতভাগ প্রণোদনার আওতায় আসেনি ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, হাসপাতাল থেকে প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তালিকা পাঠানো হয়। সে তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যায়, তারপর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রণোদনার অর্থ বারাদ্দ দেয়া হয়। তিন বিভাগের তালিকায় সমন্বয়ের অভাবের কারণেই মূলত প্রণোদনার অর্থ পেতে এত দেরি হচ্ছে।

প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, প্রণোদনার অর্থ পেতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে যারাই করোনার সময় সাস্থ্যসেবা দিয়েছেন তাদের সবাই প্রণোদনার অর্থ যথাযথভাবে পাবেন। নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন