অভিমত

করোনার নতুন বাস্তবতায় সামাজিক সংবেদনশীলতা

তানভীর শাতিল

গত এক বছরের বেশি সময়কালে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে মানবসমাজ তথা বিশ্ব যে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। নিজেদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ব্যক্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় বৈশ্বিক ঘটনাগুলোকে সংবেদনশীলতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করলেই অনুধাবন করা যায় সংকটের ভয়াবহতা। মানুষের টিকে থাকার প্রাত্যহিক লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় যে উদ্বেগটি সংযুক্ত হয়েছে, তা হলো করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। এই ভয়াবহতম সময়ে মানুষের টিকে থাকার লড়াই নানা দিক থেকে আশার সঞ্চারও করে। এরই মাঝে নানা ব্যক্তিক সামষ্টিক উদ্যোগ মানবতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যা মানবতার ডাক শুনিয়ে যায়। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংকট যে দিন শেষে সামাজিক সংকট, তা এখন একদম পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বিশ্বনেতারা সংকটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও মহামারী বাস্তবতাকে যুদ্ধাবস্থার সঙ্গে তুলনা করে এই কঠিন সময়ের নির্মমতা বুঝতে দেখা যায়।

বিশ্বজুড়ে যে মহামারী ঝড় উঠেছে, তা মোকাবেলায় সমন্বিত সুসংহত উদ্যোগের যে কোনো বিকল্প নেই বিষয়েও বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিত্জার বিজয়ী অধ্যাপক জারেড ডায়মন্ড সার্বিক করোনা বাস্তবতা বিবেচনায় মনে করেন, নভেল ভাইরাস গোটা বৈশ্বিক বাস্তবতায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন এনেছে এবং সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী; যা এরই মধ্যে প্রমাণিত। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি দেখান ফ্লু-জাতীয় অধিক সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে মানবদেহে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার সম্ভাবনা। এমনকি ভ্যাকসিন যে শতভাগ সুরক্ষাকবজ নয়, তাও  এরই মধ্যে বিশ্বময় করোনা অভিজ্ঞতা জানান দিচ্ছে।

ফলে বৈশ্বিক জাতীয় উদ্বেগকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা গত এক বছরের অধিক সময়কালে ব্যক্তিক পর্যায়ে অনুধাবনের পরিপ্রেক্ষিতে সংকটকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। আগের কথায় যদি ফিরে যাই, একটা যুদ্ধ বাস্তবতা, এমন এক শত্রু, যাকে চোখ দেখা যায় না, অনেকটাই অন্ধের মতো তরবারি চালাতে হয়। সংকটের গত এক বছরে সামাজিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিসরে যে নানা মাত্রিক প্রভাব পড়েছে, তা বিভিন্ন গবেষণা আলোচনায় উঠে আসছে। মানুষের আর্থসামজিক পরিপ্রেক্ষিতে যে ধাক্কা এসেছে, তা নিয়েই অধিক আলোচনা হয়। কারণ সংকটের ব্যাপকতার সঙ্গে শক্তভাবে লড়াই করতে গেলেই মানুষের অর্থনৈতিক তথা জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। করোনাকালীন অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে যে করোনা মোকাবেলায় মানুষের ব্যক্তিক অভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি জীবিকা উপার্জনেও কৌশলী হতে হয়। মানুষের ব্যক্তিক অভ্যাস পরিবর্তন আর জীবিকার পুনর্বিন্যাস পুনর্বাসন উভয়ই অত্যন্ত কঠিন জটিল প্রক্রিয়া। দুটি আপাত আলাদা বিষয় হিসেবে মনে হলেও দুটি বিষয় করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের কালে এক অন্যের পরিপূরক হয়ে ধরা দেয়।

বিষয়টা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে করোনাকালীন মানুষের মাঝে করোনা প্রতিরোধের সচেতনতা, অভ্যাস চর্চার হাল বিচার করলেই করোনাবিষয়ক সামাজিক অনুধাবনের চিত্র বোঝা সম্ভব হয়। জনস্বাস্থ্যগত সমস্যার প্রতিকার কতটা সম্ভব তা এখনো অনেকটাই অপরিষ্কার, তবে প্রতিরোধকারী যে স্বাস্থ্যবিধিগুলো আছে, সেগুলো কার্যকর বিষয়ে সবাই একমত। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চললেই বা প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত করতে পারলেই অনেকাংশে করোনা বিস্তারকে বসে রাখা যায়। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, গত এক বছরেও স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানুষের প্রাত্যহিক অভ্যাসে উপেক্ষিত হয়েছে, সামাজিকভাবে এর গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি আমরা।

পেশাগত দিক থেকে সমাজ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ২০২০ সালে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানুষের অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত হওযার বাস্তবতা নিয়ে একটি ফোকাসড এথনোগ্রাফিক কাজে যুক্ত ছিলাম। সেখানে দেখতে পাই দিন শেষে মানুষ তার সচেতনতা অভ্যাসে পরিণতকরণের কাজটি এককভাবে করে না। মানুষ তার প্রাত্যহিক ব্যক্তিক বাস্তবতাকে চারপাশের সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে প্রাত্যহিক এক মিথস্ক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যক্তি প্রতিনিয়ত তার চারপাশে করোনা আক্রান্ত হওয়ার নজিরকে (হারকে) নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণে মিলিয়ে দেখে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই, প্রথম ঢেউ চলাকালীন শুরুর দিককার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কড়াকড়ি, আতঙ্ক, শঙ্কা সবই ধীরে ধীরে ঢিলেতালে পর্যবসিত হয়। করোনা মহামারীর মৌলিক পরিবর্তনগুলো আমলে না নিয়ে, করোনা-পরবর্তী নতুন বাস্তবতাকে তোয়াক্কা না করে ক্রমান্বয়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে শুরু করে। সমাজে মানুষের প্রাত্যহিক অভ্যাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই মুছে যেতে থাকে, করোনা অনেকটা জুজুর ভয় হিসেবে স্থান পায় সামাজিক পরিসরে। পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এক ধরনের করোনাযুদ্ধ জয়ের পরিতৃপ্তি লক্ষ করা যায়। সরকারি-বেসরকারি সব খাতই অনেকটা স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে থাকে। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি কিছুটা সতেজ হতে শুরু করে, মানুষও চিরাচরিত সামাজিকতায় ফিরতে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, আমরা সামাজিকভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে মহামারীর ভয়াবহতা অনুধাবনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে সমন্বিত প্রচেষ্টার (বিশেষত সরকার-জনগণের সমন্বিত তত্পরতা) প্রয়োজন, তার ঘাটতি প্রকটভাবে চোখে পড়ে।

জনগণের প্রেক্ষিত থেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণের দিকে তাকাই, তবে দেখব স্বাস্থ্যবিধি চর্চায় সামাজিক উদাসীনতা। আবার রাষ্ট্রীয় দায় বিচারেও রাষ্ট্রের নীতি প্রয়োগ সর্বাঙ্গে জুতসই ছিল না। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে আমরা আবার একই চিত্র দেখতে পাই, মানুষের জীবিকা হারানোর দৃশ্য। মানুষের জীবন আর জীবিকা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানোর জন্য লকডাউনের মতো কঠোর নীতি  ব্যতীত আর কোনো বিকল্প থাকে না। থেকে যে বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায় তা হলো, গত এক বছরেও আমরা করোনার স্বাস্থ্যবিধিগুলোর গুরুত্ব তা পালন করার তাগিদ সামাজিকভাবে অনুধাবন করতে পারিনি।

এমন বাস্তবতায় সাম্প্রতিক লকডাউনের ভেতর মানুষের জীবিকা উপার্জন চলমান রাখতে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে, যেমন ঈদ সামনে রেখে নগরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট, মার্কেটগুলো খুলতে দেয়া কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলাভিত্তিক গণপরিবহন চালু করা ইত্যাদি। অর্থনীতিকে সচল রাখতে এমন সিদ্ধান্তগুলো ফলপ্রসূ করে তুলতে জনগণের কর্তব্যটুকু নিজেদের বুঝে নেয়ার সময় এসেছে, তা না হলে এগুলো কাজে আসবে না।

এর মাঝেই হতাশ চোখে লক্ষ করতে হয়, দেশব্যাপী মহামারী আর জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংকটকেও রাজনীতিকীকরণের পাঁয়তারা। মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন, পরবর্তী সময়ে মামুনুল কাণ্ড, করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি, লকডাউন প্রণয়ন সবকিছুকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বলয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখা যায় একটা মহলকে। মহামারীকালীন এগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি জনমনে সন্দেহ তৈরি করে, যা প্রকারান্তরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগের অন্তরায় হিসেবেই কাজ করে।

অবস্থায় সামনের ঈদ যাত্রা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঈদের ছুটি সংক্ষিপ্তকরণ নীতি কতটুকু কাজে আসবে, এখনো তা বলা মুশকিল। কেননা নগরের বিপণিগুলোয় ক্রেতাদের ভিড় ঈদযাত্রায় ব্যাপক চাপের পূর্বাভাসই দেয়। ফলে সমাজে ব্যক্তিক পর্যায়ে মানুষের মাঝে সংবেদনশীল মানসিকতা আচরণ তৈরির আপাত বিকল্প দেখা যায় না। একই সঙ্গে সরকারকেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবনপূর্বক নীতি প্রণয়নে কৌশলী সৃজনশীল হওয়া প্রয়োজন।

এরই মাঝে টিসিবির অনলাইন পণ্যসেবা চালুকরণের মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ যেমন চোখে পড়ছে, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষের জীবিকার পথ খোলা রাখতেও সরকারকে উদ্ভাবনী মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। এই করোনা সময়কালের অনলাইন অভিজ্ঞতা কীভাবে জনসাধারণের জীবিকা নিশ্চিতকরণে তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আরো উদ্ভাবনীমূলক চিন্তার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের প্রেক্ষাপটকে আমলে নিলে এক ধরনের বৈষম্য লক্ষ করা যায়; যা গ্রাম-শহর, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ নানা মাত্রায় বিস্তৃত। বৈষম্য দূরীকরণে সরকারকে যথাযথভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মের সময়োপযোগী ব্যবহারে আরো উদ্ভাবনী মানসিকতায় সচেতন হতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে যে ডিজিটাল সেন্টারগুলো রয়েছে, সেগুলোকে কীভাবে আরো গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। নগরকেন্দ্রিকতা একে ঘিরে যে চিরাচরিত কর্মতত্পরতা, চলাচল, সমাগমএগুলোর ব্যাপকতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নতুন করে ভাবা দরকার করোনার নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে।

সব শেষে যে বিষয়টি প্রকটভাবে অনুধাবিত হয়, করোনা বাস্তবতায় একে অন্যের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত মহামারীর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব নয়।

 

তানভীর শাতিল: উন্নয়ন গবেষক

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন