ঈদুল ফিতর

স্বাস্থ্যবিধি মানি, দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াই

মুসলিমদের বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। উৎসব ধনী-দরিদ্র আর উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ ভুলে পরিবার-আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে খুশির আয়োজনে মেতে ওঠার। কিন্তু গত বছরের মতো এবারো শঙ্কার মধ্যে ঈদ পালিত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ মোকাবেলায় সরকার চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তাই এবারো কাঙ্ক্ষিত ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে সীমাবদ্ধতা। এক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার উৎসব উদযাপনে শামিল হওয়াটাই কাম্য।

সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ঈদের সময় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে তিনদিনের বেশি ছুটি না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সব চাকরিজীবীকে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্মএলাকায় অবস্থান করতে। গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ দুঃখজনকভাবে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও থেমে নেই ঈদযাত্রা। সর্বসাধারণকে কোনোভাবে মানানো যাচ্ছে না। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও রাজধানী শহরের সীমানা পর্যন্ত চলাচল করছে সিটি বাস। প্রতিটি জেলার সীমানা পর্যন্ত ওই জেলার বাসও চলছে। সুযোগ নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষ যাচ্ছে প্রাইভেট কার মাইক্রোবাস ভাড়া করে। আবার নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকা ছাড়ার পরই ব্যবহার করছে নছিমন, করিমনসহ স্থানীয় পরিবহন। সব মিলিয়ে চিত্রটি এমন যে দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বন্ধ রেখেও মানুষের গ্রামে ফেরা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। নানা কায়দায় ছুটছে তারা। মানুষ যেভাবে গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করছে, তাতে সংক্রমণ বাড়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়ে যায়। অবস্থায় যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে। মানুষকেও আরো সতর্ক হতে হবে আনন্দ যেন নিজেদের অসতর্কতায় বিষাদে পরিণত না হয়।

প্রতি বছর ঈদের মৌসুমে ফ্যাশন হাউজগুলোর বিপুল ব্যবসা হয়। গত বছর বিপণিবিতানগুলো বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। এবার অবশ্য সরকার বিপণিবিতান চালু রাখার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করেছে। ফলে এবার কিছুটা ব্যবসা হচ্ছে, যা মন্দের ভালো। একইভাবে সময় নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদনকারী, মধ্যস্বত্বভোগী বিক্রয়কারীদের যে আয়-রোজগার হয়, তার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো। তবে গত বছরের তুলনায় এক্ষেত্রে এবার ব্যবসা ভালো। এটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর। এদিকে আকাশ-রেল-স্থল-নৌপথ প্রায় বন্ধ। ফলে পরিবহন শ্রমিকরা সমস্যায় আছেন। এখন পর্যন্ত পোশাক খাতের ২৫ শতাংশ কারখানার বেতন-ভাতা অপরিশোধিত বলে খবর মিলছে। ঈদ উদযাপন যেন আনন্দময় হয়, সেজন্য শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দ্রুততম সময়ে পরিশোধ করা জরুরি। অনেক কারখানায় ছুটি বাড়ানো নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। এরও একটা সুষ্ঠু বিহিত প্রয়োজন। শুধু পোশাক নয়, বেসরকারি খাতের কর্মরত অনেক কর্মীই বেতন-ভাতা পাননি। ফলে সংসারের ব্যয় নির্বাহ আনন্দ উদযাপনে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের বেতন-ভাতাদি দ্রুত নিশ্চিত করা চাই।

এদিকে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঘুরতে যায়। এতে পর্যটন শিল্প চাঙ্গা হয়। কিন্তু এবার বিধিনিষেধ থাকায় পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিধিনিষেধের আওতায় যেসব শিল্পের কর্মীরা আয়-উপার্জন করতে পারেননি, তাদের পাশে থাকতে হবে রাষ্ট্রকে। লকডাউনে বিপুল শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে তারা হিমশিম খাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী কষ্টে দিনাতিপাত করছে। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে তাদের নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। এটাকে আরো বেগবান করতে হবে। সরকারের বহুমাত্রিক প্রয়াসে অসহায় জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সবাইকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা চাই। ইসলামে ঈদের সময় সদকাতুল ফিতর জাকাত প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, সমাজ-রাষ্ট্রে যেন সম্পদের পুনর্বণ্টন হয়। এটি আমলে নিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিদেরও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে ঈদ আনন্দ সর্বজনীন হয়ে ওঠে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে ঈদের শিক্ষা হলো সাম্য, ভ্রাতৃত্ব একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ। ঈদ আমাদের সামষ্টিক জীবনে যে মিলন শুভবোধের চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তা সঞ্চারিত হোক নিত্যকার জীবনযাপনে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে সামাজিকতা মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই ঈদের মূল তাত্পর্য। করোনা দুর্যোগ থেকে নিজে নিরাপদ থাকা এবং অন্যকে নিরাপদ রাখাই হোক এবারের ঈদের মূলমন্ত্র। খোলা ময়দানের পরিবর্তে মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের জামাত আয়োজনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবার। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এটা মেনে চলা জরুরি।

প্রতিবেশী দেশ ভারত করোনার দ্বিতীয় প্রবাহে পর্যুদস্ত। মৃত্যু বেড়েই চলছে। আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জনসমাগম, জনসভা করা এবং দলে দলে ধর্মীয় সভায় যোগ দেয়া। দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো হওয়া সত্ত্বেও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতীয় ধরন আমাদের দেশে শনাক্ত হয়েছে। সরকার সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় নীতি-নির্দেশনা দিয়েছে।  চেষ্টা করছে পরিস্থিতির যেন আর অবনতি না ঘটে। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নাজুক। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর অক্সিজেনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে। কাজেই আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা সতর্কতা বেশি প্রয়োজন।

আসুন সবাই দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যথাযথ সতর্কতার সঙ্গে শামিল হই আনন্দ উদযাপনে, সাম্যের বন্ধনে প্রাণ মেলাই সামাজিক দূরত্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। আমরা প্রত্যাশা করি, শিগগির কেটে যাবে দুর্যোগের আঁধার। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন