সঞ্চয় নেই নিম্নবিত্ত-প্রান্তিক মানুষের ব্যাংক হিসাবে

হাছান আদনান

কৃষি আর কৃষককে মনে করা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া। যদিও দেশে কৃষকদের বড় অংশেরই অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর পর অর্থ উদ্বৃত্ত থাকছে না কৃষকের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের প্রায় এক কোটি কৃষকের ব্যাংক হিসাবে গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ মাত্র ৪১৮ টাকা। কৃষকদের মতোই দেশের অন্যসব নিম্নবিত্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঞ্চয় পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। চলমান মহামারী এসব শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে।

দেশের মোট ব্যাংক হিসাবের এক-পঞ্চমাংশ ১০, ৫০ ১০০ টাকা দিয়ে চালু করা। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে এসব ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে বিশেষ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়ায় কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৪২-এ। এসব ব্যাংক হিসাবে সঞ্চিত রয়েছে হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর প্রতিটি ব্যাংক হিসাবে গড়ে হাজার টাকার আমানতও নেই। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাংক হিসাবে জমা আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ আমানত। বিশেষ ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে ৬৯ লাখ ২৯ হাজার হিসাব সরকারি ভর্তুকিতে সচল রাখা হয়েছে।

কৃষকের পাশাপাশি বিশেষ ব্যাংক হিসাবধারীদের মধ্যে রয়েছে হতদরিদ্র, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগী, খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন শ্রমিক, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শুধু বিশেষ ব্যাংক হিসাবই নয়, বরং দেশের মোট ৬৯ শতাংশ ব্যাংক হিসাবধারীর সঞ্চয় পরিস্থিতি নাজুক। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে আমানতের মোট ব্যাংক হিসাব ছিল ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার ১৪০টি। এসব ব্যাংক হিসাবের মধ্যে কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার ৬৯৬টি ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ ছিল হাজার টাকার কম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশ মূলধারার ব্যাংকিং সেবার বাইরে। যে ৩০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছে, তারও বড় অংশের সঞ্চয় নামমাত্র। সরকারি ভর্তুকির আওতায় থাকা প্রান্তিক কৃষকসহ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না। গত বছরের শুরুতে করোনার প্রথম ধাক্কায় নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষ সঞ্চিত অর্থ থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় এসব মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে।

ব্র্যাকের চেয়ারপারসন . হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, স্বাভাবিক সময়েও স্বল্প উপার্জনের মানুষকে জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেতে হয়। ফলে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কোনো সঞ্চয় থাকে না। আর করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিম্ন দরিদ্র মানুষের সঞ্চয় থাকবে, তার প্রত্যাশাও বৃথা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের জরিপের ফলাফল হলো চলমান মহামারীতে নতুন করে দেশের কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আমাদের জরিপ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, সেটি নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকার যে পদ্ধতিতে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সেটি আগের মতোই ব্যর্থ হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশেষ সুবিধার আওতায় ১০ টাকার ব্যাংক হিসাবের ৪৩ শতাংশ খুলেছেন কৃষকরা। গত ডিসেম্বর শেষে কৃষকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৭ লাখ ২৮ হাজার ৫১৮। কৃষকদের বিশেষ হিসাবগুলোর মধ্যে ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২টি সরকারি ভর্তুকি প্রদানের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া ৩৬ হাজার ব্যাংক হিসাব ২০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষকদের ব্যাংক হিসাবগুলোতে আমানত ছিল ৪০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। হিসেবে কৃষকদের প্রতিটি ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয়ের পরিমাণ মাত্র ৪১৮ টাকা।

বিশেষ ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় খোলা হয়েছে ২৮ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব হিসাবে জমার পরিমাণ ২০২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অতিদরিদ্রদের ব্যাংক হিসাবে গড়ে ৭০৭ টাকা সঞ্চয় আছে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগী ৭৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮৪টি ব্যাংক হিসাবে ৭৫১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচির ৭৭ হাজার ৭১১টি হিসাবে কোটি ৪৪ লাখ টাকা, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ১০ হাজার ১৬১টি ব্যাংক হিসাবে কোটি লাখ, তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের লাখ ৪৫ হাজার ৭২১টি ব্যাংক হিসাবে ১৫৮ কোটি ৯৪ লাখ, পাদুকা শিল্পের শ্রমিকদের হাজার ৬৩৬টি ব্যাংক হিসাবে মাত্র ৯৬ লাখ প্রতিবন্ধীদের লাখ ৭৭ হাজার ২৭২টি ব্যাংক হিসাবে ৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা আমানত আছে। সরকারের ন্যাশনাল সার্ভিস প্রোগ্রামের আওতায় খোলা ৬৩ হাজার ৭৫০টি ব্যাংক হিসাবে আমানত আছে ৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

নগদ টাকাই দরিদ্র মানুষের মূল সম্পদ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চলমান মহামারীতে বহু মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দরিদ্র মানুষের গাড়ি-বাড়ি থাকে না। স্বল্প সঞ্চয়ই নিম্নবিত্ত মানুষের প্রধান ভরসা। কিন্তু সঞ্চয়ের অবস্থা যে খুবই নাজুক, তা পরিসংখ্যান থেকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র মানুষের জন্য চাল-ডাল দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মহামারীতে এটি কখনই সমাধান হতে পারে না। দুর্ভিক্ষের সময়ে খাদ্যসহায়তা কার্যকর ভূমিকা রাখে। এখন তো দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে না।

. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা করোনা সৃষ্ট মানবিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। দেশে প্রকৃত দরিদ্র কারা, এনজিওগুলোর কাছে সে তথ্য আছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের কাছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এনজিওগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। নিজ উদ্যোগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন