বাংলাদেশকে বড় চাপে ফেলে দিয়েছে চীন

নিজস্ব প্রতিবেদক

চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেংহি সম্প্রতি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। সফর চলাকালে দেশগুলোর প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কোয়াড্রিলেটারাল জোটের (কোয়াড) ক্রমবর্ধমান তত্পরতার বিরোধিতা করার আহ্বান জানান তিনি।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন এরই মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে টিকা সরবরাহসহ বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়াতে আবারো তত্পর হয়ে উঠেছে দেশটি। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে কোয়াড জোটকেই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখছে বেইজিং। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গড়ে তোলা চতুর্দেশীয় জোটটির বড় হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের বক্তব্যে নিয়ে সক্রিয়তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অবস্থায় কোয়াডকেই সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছে চীন। কারণেই জোটটি থেকে দূরে থাকার জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে বেইজিং।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংও গতকাল বলেছেন, কোয়াডে যুক্ত হলে বাংলাদেশ চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ হবে। ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত এক আলোচনায় অংশ নিয়ে লি জিমিং বলেন, চীন সব সময় মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড হচ্ছে চীনবিরোধী একটি ছোট গ্রুপ। আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, অর্থনৈতিক প্রস্তাবের কথা বললেও এতে নিরাপত্তার উপাদান আছে।

কোয়াডে অংশগ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রেক্ষাপটে বলব, ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়ার ভাবনাটা ভালো না। বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)দুটির সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহে ভারতের ব্যর্থতা ঢাকাকেন্দ্রিক কূটনীতিতে চীনকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশও ধরনের ক্ষেত্রে বরাবরই নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। নিয়ে ঢাকার কাছে সরাসরি কোনো প্রস্তাবও আসেনি। তবে কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর সাম্প্রতিক চীনের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে। সে জায়গা থেকে আগাম বার্তা হিসেবে গতকাল বক্তব্য রাখতে পারেন লি জিমিং।

প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, কোয়াডে যোগ দেয়ার বিষয়ে এখনো সরাসরি কোনো প্রস্তাব আসেনি বা বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও নিয়ে কোনো পলিসি হয়নি। তবে জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর আকার-ইঙ্গিতে ভারত বা জাপানের অনুরোধ থাকতে পারেএমন ধারণা থেকেই চীন হয়তো আগাম একটি বার্তা দিয়েছে। তবে যে পরিপ্রেক্ষিতেই দিক, বার্তাটি একটু বেশিই স্পষ্ট। এর মাধ্যমে কোয়াড নিয়ে চীনের অস্বস্তিই প্রকাশ পাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, কোয়াডের বিষয়টিকে বেইজিং ভালো চোখে দেখছে না। এতে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ যোগ দিলে চীন তা পছন্দ করবে না, এটিই স্বাভাবিক। তারা এখন বার্তাই দিচ্ছে।

বলা হচ্ছে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি মোকাবেলার জন্য প্রায় বিস্মৃত কোয়াড জোটকে ক্রমেই সক্রিয় করে তুলছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান অস্ট্রেলিয়া। অন্যদিকে চীন শুরু থেকেই জোটের সমালোচনায় মুখর রয়েছে। বিষয়ে বেইজিংয়ের বক্তব্য হলো শুধু বেইজিংকে মোকাবেলা করতেই গড়ে তোলা হয়েছে জোটটি।

অন্যদিকে কোয়াডভুক্তরা বলছে, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন নৌ-চলাচল, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি নিশ্চিতের উদ্দেশ্য থেকে জোটটি গড়ে তোলা হয়েছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে তারা এখন চীনকেই সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোও এখন তত্পরতা বাড়াচ্ছে। ফ্রান্স অতি সম্প্রতি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে। অঞ্চলকে সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছে জার্মানি। এসব ঘটনায় ভবিষ্যতে অঞ্চল নিয়ে কোয়াডের সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলোর জোটবদ্ধ প্রয়াস গ্রহণের আভাস পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই বেইজিংয়ের কোয়াড নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে বলে অভিমত তাদের।

ভারতের প্রতিশ্রুতিমাফিক ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে না পারাকে কাজে লাগাতে এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় টিকাকেন্দ্রিক কূটনীতি জোরালো করে তুলেছে চীন। এরই মধ্যে অঞ্চলে টিকা মজুদের নতুন প্লাটফর্ম ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কভিড ফর সাউথ এশিয়া গড়ে তুলেছে চীন। প্লাটফর্মে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশও। প্লাটফর্মের অন্য সদস্যরা হলো আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল শ্রীলংকা। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই প্রথম বাংলাদেশ এমন কোনো প্লাটফর্মে যোগ দিল, যেখানে ভারত নেই।

চীনা টিকার প্লাটফর্মে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে জানান, জরুরি প্রয়োজনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের টিকা পেতে চীনের উদ্যোগে নতুন প্লাটফর্মে যুক্ত হতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। চীনের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোও সম্মতি দিয়েছে। জোটের কাজ হবে কভিডের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা।

বাংলাদেশকে চীনের উপহার হিসেবে দেয়া পাঁচ লাখ ডোজ টিকা আগামীকাল নাগাদ দেশে পৌঁছার কথা রয়েছে। তবে বাংলাদেশকে কেনা টিকা পেতে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি জানান, টিকা নিয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং বাংলাদেশে টিকা পাঠানোর বিষয়টিকে চীন খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছে। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশ সরকার চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ আগে। এখন টিকা পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ টিকার জন্য সেই লাইনের সম্মুখভাগের খুব কাছাকাছি অবস্থানেও নেই।

চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি বলতে চাইছি, সরকারি পর্যায়ে চীন থেকে কেনা টিকার প্রথম চালান হাতে পেতে আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

কতদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে, সে ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আপাতত আমি যেটুকু বলতে পারি, বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের টিকা কেনার জন্য আমার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। বেইজিংয়ে আমার সহকর্মীরা প্রথমে আমাকে যেটা বলেছেন, ওই লাইন এত বেশি দীর্ঘ যে ডিসেম্বরের আগে টিকা পাওয়ার আশা না করাই ভালো। আমি তাদের বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব এখানে টিকা দরকার। এরপর আমার মনে হচ্ছে, ডিসেম্বরের অনেক আগেই আমরা পারব। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বছরের প্রথমার্ধে সেটা হবে না।

লি জিমিং বলেন, টিকা উপহার দেয়ার জন্য চীন যোগাযোগ করেছিল বছর ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার টিকার জরুরি অনুমোদনের সময় নিয়েছে প্রায় তিন মাস। ফলে বাংলাদেশে টিকা বিক্রির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার বিষয়টি নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। আমি আশা করব, বাংলাদেশ সরকার ধরনের কাজে আরো উদ্যোগী হবে, বিশেষ করে মহামারীর মতো বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা যখন আমাদের করতে হচ্ছে।

চীনের বর্তমান অবস্থানকে ডিপ্লোমেটিক অফেনসিভ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। নেপালি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বিনোজ বাসনিয়াত সম্প্রতি দেশটির স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে লিখেছেন, চীনের আগ্রাসী কূটনীতিতেই বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দেশটির সম্পৃক্ততা বাড়ানোর ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছে। চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহি তার সফর চলাকালে দক্ষিণ এশিয়ায় বহিরাগতদের (যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বে সামরিক জোট স্থাপনের বিরোধিতা করার জন্য শ্রীলংকা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কোয়াডকে চীন এখন দেখছে বেইজিংবিরোধী এক ছদ্ম সামরিক জোট হিসেবে, যা ইন্দো-প্যাসিফিকে ন্যাটোর মতো আরেকটি জোটের সূচনামাত্র। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং - গত কয়েক মাসে চীনের কাছাকাছি অনেকগুলো দেশ সফর করেছেন। নিয়ে বলা হয়েছে, চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সামরিক দিক থেকে আস্থার জায়গা বাড়াতে এসব সফরের আয়োজন করা হয়। বহুমুখী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের হাত থেকে চীনের নিজস্ব স্বার্থকে সুরক্ষা দিতেই এসব সফরের আয়োজন করা হয়। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এখন চীনের সামরিক সহযোগিতার মাত্রাও বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন