সাত-সতেরো

দৈনন্দিন জীবনে প্যারেটোর নীতি

মো. আব্দুল হামিদ

আপনার স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে কতজন ভালো বন্ধু ছিল? অর্থাৎ বহুদিন পরেও যোগাযোগ আছে, নিঃসংকোচে সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারেন সংখ্যাটা কেমন? প্যারেটোর নীতি বলছে, তা মোট ক্লাসমেটের ২০ পার্সেন্টের বেশি নয়! আবার দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সত্যিকারের প্রোডাক্টিভ কাজকর্ম করেন কত ঘণ্টা? বড়জোর - ঘণ্টা, তাই না? এটাও কিন্তু ২০ পার্সেন্টের কাছাকাছি। এভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাঁচ ভাগের এক ভাগ কাজকর্মই মোটামুটি পুরো ফলকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে।

বুঝতে অসুবিধা হলে আরেকটু সহজ করে বলি। ধরি, আজকের দিনে আপনার দশটা কাজ করা দরকার। অগ্রাধিকার অনুযায়ী এক থেকে দশ পর্যন্ত তালিকা করুন। তারপর প্রথম দুটো কাজও যদি সঠিকভাবে করতে পারেন, তবে দিনের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। বাকিগুলো পুরোপুরি করা সম্ভব না হলেও বড় কোনো সমস্যা হবে না। অর্থাৎ সেগুলোর প্রভাব আপনার ব্যক্তি কর্মজীবনে তুলনামূলকভাবে বেশ কম।

কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ পেশাগত কাজগুলো উপভোগ করে না। ফলে সবচেয়ে জরুরি কাজগুলো বিরক্তিকর ঠেকে, বোঝা মনে হয়। তাই সেই কাজগুলোর ক্ষেত্রে ভাবে: কাল করব, শিগগিরই করে ফেলব। কিন্তু সেটা নিয়ে আর বসা হয় না। অন্যদিকে খুব যত্নসহকারে (করতে ভালো লাগে কিন্তু) কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অথচ সেগুলো খুব ভালোভাবে সম্পাদন করলেও তা মোট অর্জনের ২০ ভাগের বেশি হবে না! তাই ব্রায়ান ট্রেসি ইট দ্যাট ফ্রগ বইতে বলেছেন, যত কষ্টকরই হোক না কেন (নাশতার টেবিলে ব্যাঙ খাওয়ার মতো) সর্বপ্রথম ওই ২০ ভাগ কাজ শেষ করুন, যা ফলাফল বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।  

যাহোক, শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় ১৮৯৭ সালে দেয়া প্যারেটোর ৮০/২০ নীতি। প্রায় ১২৫ বছর পরও আমরা এটা নিয়ে কথা বলছি। তার মানে ওই ধারণাটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব ক্ষেত্রে খাতা-কলমে ফলাফল একই (২০ বা ৮০) হবে, ব্যাপারটা তেমনটা নয়। তবে মোটের ওপর ধারণা পাওয়ার জন্য এটা কার্যকর একটা তত্ত্ব। ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ ভিলফ্রেদো প্যারেটোর নামে পরিচিত থিউরির মূলকথা হলো, আমাদের ৮০ ভাগ অর্জনে অবদান রাখে মাত্র ২০ ভাগ কাজ। তার মানে অবশিষ্ট ২০ ভাগ অর্জনে অবদান রাখে বাকি কার্যক্রম।

তিনি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমন ফল পেয়েছিলেন। যদিও মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর সত্যতা মেলে। খুব সহজ উদাহরণ হলো, আপনার দশটি ড্রেস থাকলেও দেখবেন অহরহ পরা হয় দুই-তিনটা। আবার একটা দোকানের ২০ ভাগ নিয়মিত ক্রেতা তাদের মোট বিক্রির ৮০ ভাগ দ্রব্য কেনে। ঠিক তেমনিভাবে একজন সেলসম্যান তার ৮০ ভাগ পণ্য বিক্রি করে মাত্র ২০ ভাগ ক্রেতার কাছে।

ফেসবুকে আপনার মোট বন্ধুর বড়জোর পাঁচ ভাগের এক ভাগের পোস্ট পড়া হয় কিংবা ইউটিউবে যতগুলো ভিডিও দেখেন, তার ২০ শতাংশের বেশি তৃপ্তি দেয় না! অর্থাৎ সিংহভাগের প্রভাব বা অবদান সামান্য। অন্যদিকে অল্পকিছুর প্রভাব বা অবদান তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আত্মীয়তার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্বল্পসংখ্যক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই বেশির ভাগ যোগাযোগ বা ভাবের আদান-প্রদান হয়।

আবার ধরা যাক, একজন প্রকাশক বছরে ১০টা বই বের করেন। এই তত্ত্ব মোতাবেক মাত্র দুটো বই তার মোট বিক্রির ৮০ ভাগ অবদান রাখবে! তাহলে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, প্রকাশক কেন শুধু সেই দুইটা বই ছাপান না? তা করা গেলে অবশ্যই খুব ভালো হতো। কিন্তু John Wanamaker যেমনটা বলেছেন, Half the money I spend on advertising is wasted; the trouble is I don’t know which half. তাই প্রত্যাশিত ফল পেতে বিজ্ঞাপনের পুরোটা অর্থই ব্যয় করতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে ব্যবসাসফল দুটো বই পেতে হলে তাকে অবশ্যই দশটা বই পাবলিশ করতে হবে।

বলতে পারেন, প্রকাশক-সম্পাদক মিলে তো খুব ভালো বই সিলেক্ট করতে পারেন। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু তাদের আর পাঠকের উভয়ের ভালো যে একই বিন্দুতে মিলবে, তার নিশ্চয়তা কী? পাঠক-দর্শক-শ্রোতা ঠিক কোন কারণে একটা পণ্য গ্রহণ (বা বর্জন) করে, তা এক বিরাট ধাঁধা। জাস্ট ভাবুন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে জাহিদ নামের এক কিশোর মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা গানটি গেয়ে নেট দুনিয়ায় ঝড় তুলল। অথচ সেই গানটি রবি চৌধুরী, নিশিতা বড়ুয়া, সালমার মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও গেয়েছেন। কিন্তু অখ্যাত সেই কিশোরের ভার্সনটা জনগণ গ্রহণ করেছে। ঠিক তেমনিভাবে একজন প্রকাশক ভালো মনে করলেই সেই বইটা পাঠক গ্রহণ করবেসবসময় সেটা হয় না।  

যাহোক, পরবর্তীকালে অসংখ্য গবেষক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নীতি একইভাবে প্রযোজ্য কিনা, তা বোঝার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তারা অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, এমনকি সামাজিক অসংখ্য ক্ষেত্রেও একই রকম ফল পেয়েছেন। এটা যে শুধু ইতিবাচক ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তা কিন্তু না। বরং দেখা গেছে কোনো দপ্তরের ৮০ ভাগ দুর্নীতি করে মাত্র ২০ ভাগ কর্মী। ফলে পুরো প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম হয়। আবার কোন শহরের সিংহভাগ অপকর্ম করে মাত্র ২০ ভাগ সন্ত্রাসী বা চোর-ডাকাত! কিংবা একটা কারখানায় ৮০ ভাগ ঝুঁকির উদ্ভব হয় মাত্র ২০ ভাগ ফ্যাক্টর থেকে।

এখন কথা হলো, নিয়মটা জেনে আপনার কী লাভ? তা হলো, দুধ দেয়া গাই বা সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে চেনা জরুরি। মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয় না। অর্থাৎ সব পণ্যের ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দিয়ে কৌশল নির্ধারণ করলে দিন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ আপনি যতই খৈল-ভুসি খাওয়ান না কেন, সব ঘোড়া একই গতিতে দৌড়াবে না। তাই রেসে জেতার সামর্থ্য রাখে এমন ঘোড়ার ব্যাপারে বিশেষ যত্ন-আত্তি করতে হবে।

তাহলে কি বাকি ৮০ পার্সেন্টকে অবহেলা করবেন বা ফেলে দেবেন? না, অবশ্যই না। ব্যাপারটি বোঝার জন্য একটা ওষুধের দোকান ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। দেখবেন সেখানে অসংখ্য আইটেম থাকে, যা মাসেও দুই চারটা বিক্রি হয় না। তার পরও সেটা শেষ হলে দোকানদার আবার সংগ্রহ করেন। কিন্তু কেন সেটা করেন? তিনি তো ভাবতে পারতেন, ওইসব স্লো আইটেম রাখা লস। অযথা দোকানের স্পেস নষ্ট করার দরকার নেই!

বাস্তবে সেটা হয় না একাধিক কারণে। প্রথমত, যে দোকানের কালেকশন যত ভালো, ক্রেতারা সেই দোকানের প্রতি তত বেশি আস্থা রাখে। অনেক দূর থেকেও সেখানে আসে এজন্য যে একই স্থানে সব ওষুধ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, অতি পরিচিত আইটেমে খুব বেশি লাভ করা যায় না। কারণ কাস্টমার সেগুলোর দাম সহজেই তুলনা করতে পারে। কিন্তু নাম জানে না, জীবনে প্রথমবারের মতো কিনছে এমন ওষুধের দাম যা- রাখা হোক, তারা আপত্তি করে না। সেটা নিয়ে নেতিবাচক কথাও হয় না।

সর্বোপরি কথা হলো, পণ্য সংগ্রহ, মজুদ, দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিলসব খরচ মজুদকৃত আইটেমগুলোর ওপর ভাগ হয়ে যায়। শুধু কয়েকটা চালু আইটেম দিয়ে ব্যবসা করতে গেলে তা কোনোভাবেই পোষাবে না। তখন তার পণ্যের দাম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি রাখতে হবে। আর সেটা যে আত্মঘাতী হবে, আশা করি তা বুঝতে পারছেন। ঠিক তেমনিভাবে কোনো ব্যাচের সব শিক্ষার্থীই পঠিত বিষয়ে খুব মনোযোগী হবে না। আমাদের জীবনে অর্জিত মোট সম্পদের খুব অল্প অংশই ভোগ করার সুযোগ মিলবে। তার পরও মানুষ নানা অবৈধ পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়েঅভাবে নয়, খুব সম্ভবত স্বভাবে!

আবার কোনো জনগোষ্ঠী সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্যও অন্তত ২০ ভাগ লোককে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কারণ সমাজের সব সদস্যই সামষ্টিক বিষয়ে মাথা ঘামায় না বা একই রকম ভূমিকা রাখে না। ঠিক তেমনিভাবে একটা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২০ ভাগ লোক সততা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও সুনাম অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে! এমনকি কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করতেও অন্তত এক-পঞ্চমাংশ ত্যাগী কর্মীর দরকার হয়। আমাদের সারা জীবনে পাওয়া মোট সময়ের ২০ পার্সেন্টও ঠিকমতো কাজে লাগালে উল্লেখযোগ্য অর্জন করা সম্ভব

এখন আমরা কানেক্টেড থাকার অজুহাতে অপ্রয়োজনীয় কাজ বিতর্কে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছি। এক্ষেত্রে সেদিন ফেসবুকে তত্ত্বের বেশ মজার এক ব্যাখ্যা পেলাম। সেখানে বলা হয়েছে, আমরা যদি নিজেদের চোখ, কান মুখের ক্ষেত্রে প্যারেটোর নীতি অনুসরণ করি, তবে জীবন অনেক ঝামেলামুক্ত হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ দুই চোখ দুই কান দিয়ে ৮০ ভাগ ইনপুট নেব, আর মাত্র ২০ ভাগ (মুখ) দিয়ে আউটপুট দেব! অর্থাৎ যা দেখব শুনব, তার এক-পঞ্চমাংশ বলব, তার চেয়ে বেশি নয়। সত্যিই সেটা করা গেলে নানা অযাচিত বিষয় এড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া সম্ভব হতো!

নোট: ব্যাপারে আরো জানতে আগ্রহীরা Richard Koch-এর লেখা The 80/20 Principle: The Secret of Achieving More with Less বইটি পড়তে পারেন। আমার বেশ ভালো লেগেছে।

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক   মস্তিষ্কের মালিকানা বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন