অভিবাসীদের ৭৭ শতাংশ হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেছেন

প্রবাসফেরতদের নগদ সহায়তা দেয়া হোক

কয়েক দশক ধরে তো বটেই, সাম্প্রতিক সময়ে কভিডের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায়ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে উঠলে প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে কেউ দেশে ফেরত এসেছেন, কেউ যেখানে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ক্রমেই সংকট বেড়ে উঠছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিড মহামারীতে গত বছরের এপ্রিল-নভেম্বর সময়কালে আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশ হন্যে হয়ে দেশে চাকরি খুঁজেছেন। ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল যে মিলছে না তার প্রমাণ গবেষণা প্রতিবেদন। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের সহায়তার প্রক্রিয়া ব্যবস্থাপনা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে বৈকি।

বিশ্বব্যাপী করোনার কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আমাদের যেসব শ্রমিক প্রবাসে ছিলেন, তাদের বেশির ভাগ সেখানকার অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা রকম কাজে যুক্ত আছেন। করোনার কারণে অনেক দেশে এসব কাজের চাহিদা কমে গেছে। কারণে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। তাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অবস্থায় কেবল দেশে ফেরত শ্রমিকরা নন, তাদের পুরো পরিবারই ঝুঁকিতে আছে। সরকার দেশে ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকদের পুনর্বাসনে ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার যে বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছে, তার শতাংশের কম বিতরণ হওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক। প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশ ঋণসুবিধা সম্পর্কে জানেন না। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হলেও সারা দেশে এর শাখা মাত্র ৬৬টি। বিদেশফেরত শ্রমিকদের ঋণসুবিধা দিতে হলে অন্যান্য ব্যাংকের সহায়তা নিতে হবে। প্রয়োজনে সুদের হার আরো কমাতে হবে। তাছাড়া প্রবাসী শ্রমিকরা ঋণ নিয়ে কী করবেন? তারা দীর্ঘদিন চাকরি করে এসেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই ঋণ দেয়ার আগে বিদেশফেরত শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ সমবায় পদ্ধতিতে সামাজিক ব্যবসায় ঋণ দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ না দিয়ে শ্রমিকদের ঋণ দিয়ে সরকার বা প্রবাসী মন্ত্রণালয় দায়িত্ব শেষ করলে বিদেশফেরত শ্রমিকরা লাভবান হবেন না। একই সঙ্গে নারী শ্রমিকদের আলাদা প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই ব্যবসা করতে পারেন। বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদানে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া, এমনকি শ্রীলংকার উদাহরণ আমলে নেয়া যেতে পারে। দেশগুলো নগদ আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রবাসফেরতদের দক্ষ করে তুলতে নানামুখী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান তৈরিতে জোর দিয়েছে। শ্রীলংকা দক্ষ সেবিকা তৈরির মতো প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ধরনের কোনো উদ্যোগও নিতে পারে।

ফেরত আসা প্রবাসীদের সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়া যায়। ফেরত আসা দক্ষ লোকজনকে দেশের ভেতরেই চাকরি দেয়া যায়। দেশে চলমান নির্মাণ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট প্রবাসফেরত শ্রমিকদের নিয়োজিত করা যেতে পারে। আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা আধুনিক জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাদের সে জ্ঞান ব্যবহার করেও দেশ উপকৃত হতে পারে। তবে একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, করোনা স্বাস্থ্য খাতের একটা সমস্যা। কাজেই বাংলাদেশকে করোনামুক্ত করতে হবে পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে। নয়তো বাংলাদেশীদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। তবে সংকটময় সময়ে রাষ্ট্রসহ সবার প্রবাসীদের পাশে থাকাটা জরুরি। কেননা প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের অর্থে দেশের রিজার্ভ আজ শক্তিশালী। এটি ব্যবহার করে এখন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। তাই করোনার সংকটময় সময়ে তাদের পাশে থাকতে হবে। পাশাপাশি অভিবাসন খাতকে স্বাভাবিক করা করোনা-পরবর্তী নতুন বিশ্বের জন্য যেসব খাতে দক্ষ লোকের দরকার, সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে এখনই।

ফিরে আসা প্রবাসীদের দেশে কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন আর্থিক প্রণোদনা। অন্যদিকে যারা দেশের বাইরে আছেন, তাদের কর্মসংস্থান স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। এছাড়া বিদেশে যারা যেতে আগ্রহী যারা ফেরত যেতে চান, তাদের জন্য কূটনৈতিক তত্পরতার পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। ফিরে আসা প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের জন্য বিদ্যমান প্রণোদনা মূলত ব্যাংকিং চ্যানেল শর্তভিত্তিক ঋণ হওয়ায় অনেকেই এর সুবিধা নিতে পারছেন না। প্রণোদনার অর্থ ছাড়ে জটিলতা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংকের যেমন ঋণের শর্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন, তেমনি অভিবাসীদের জন্য সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোও জরুরি। তবে ঋণসুবিধার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের তথ্যসহায়তা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন রয়েছে। স্বনিয়োজিত কাজ ছাড়া, ফেরত আসা প্রবাসীদের দক্ষতা দেশীয় বাজারে কাজে লাগানোর জন্য বিএমইটি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে নগদ সহায়তার ব্যবস্থা

প্রশংসনীয় হলেও প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল। প্রবাসী কল্যাণ তহবিলের অর্থের ক্ষেত্রে অভিবাসীদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। বিদেশে ফেরত যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত বিমান ফ্লাইটের ব্যবস্থাসহ কিছু ক্ষেত্রে ভিসা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য কভিড টেস্টের ব্যবস্থা থাকাও দরকার। একই সঙ্গে তাদের টিকা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য নিজ অর্থায়নে বিদেশে গিয়ে টিকা প্রদান করছে। বাংলাদেশও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক কিংবা আমলাতান্ত্রিক সক্ষমতা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল, যা এক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কারের অন্তরায়। এছাড়া সার্বিকভাবে আমাদের অভিবাসীরা স্বল্প দক্ষ নিম্ন উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত থাকায় যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক অভিঘাত তাদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তাই মধ্যম বা দীর্ঘমেয়াদে অভিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার অভিবাসীদের বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। ফেরত আসা প্রবাসীরা আর্থিক সংকটে থাকায় হন্যে হয়ে চাকরির সন্ধান করছেন। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বেশি, তার ওপর করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্ম হারিয়েছেন অনেকে। গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মসংস্থানের সুযোগও সম্প্রসারিত হয়নি। সব মিলিয়ে দেশে চাকরির বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। ফলে দ্রুতই অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের বাজার বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বিদেশী বাজারই এক্ষেত্রে ভরসা। আর সেটি ধরতে হলে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন