গুরুত্বারোপ

করোনাসৃষ্ট দারিদ্র্য মোকাবেলায় করণীয়

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

করোনায় পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অনানুষ্ঠানিক খাত। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এ খাতে নিয়োজিত। আমাদের শ্রমবাজারের ৮৫-৮৭ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের অধিকারে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রতি নীতি মনোযোগ বা নীতিসহায়তা প্রদানের হার কম। সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে অথচ নজর দেয়া হয়েছে কম। নজর কম দেয়ার অন্যতম কারণ দুর্বল কণ্ঠশক্তি। তাদের দাবিগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছার মতো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলছে না। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এ শ্রেণীর মানুষেরা সমস্যাটি হয়তো জানে। কিন্তু ক্ষমতার দরবারে পৌঁছার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। আবার এ কথাও সত্য, তাদের বিষয়গুলো বিচ্ছিন্নভাবে অনেক সময় তুলে ধরা হয়েছে। তবে সরকারি মহলের মধ্যে তা কেবল শোনার পর্যায়ে রয়ে গেছে। অনেকটা টোকেনিজমের মতো।

গত বছর করোনা মোকাবেলায় সরকারি চিন্তায় দুটো জায়গায় দুর্বলতা দেখা গেছে। এক. প্রথম থেকেই সরকার করোনাকে একটা স্বল্পকালীন সমস্যা হিসেবে দেখেছে। স্বাস্থ্যের বিষয়ে প্রথমে নজর দেয়া হলেও পরে হাল ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। দুই. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষাকেও একটি স্বল্পমেয়াদি অ্যাপ্রোচ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিছু জিআর বাড়ানো হয়েছিল, ওএমএস চালু করা হয়েছিল, পরে আবার সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এজন্য নতুন অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়নি। কাবিখা কিংবা ইজিপিপি ওই সময় বন্ধই ছিল। সুতরাং ওই বরাদ্দ এখানে দেয়া গেছে।

সরকার করোনা সংকটকে একটা স্বল্পকালীন সমস্যা হিসেবে দেখার ফলে এক ধরনের স্বল্পকালীন মোকাবেলা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে বিষয়টি। কেবল একটা নতুন উদ্যোগ ছিল—আড়াই হাজার টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দেয়া। নতুন ধারণা বটে, তবে বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো নতুনত্ব দেখা যায়নি। ফলে এ কর্মসূচিরও কার্যকারিতা খুব একটা মেলেনি। তালিকা ঠিকমতো না হওয়াসহ কিছু অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে এতে। তালিকা যে ঠিক হয়নি, তা আসলে সরকারের গৃহীত বাস্তবায়ন কৌশলের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। সরকার মূলত আমলাতান্ত্রিক পথেই হেঁটেছে এবং সেখানে কোনো ধরনের নতুনত্ব ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার মাধ্যমে কর্মসূচিগুলো গতানুগতিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দলীয় চিন্তা ও দুর্নীতি চলে আসায় কর্মসূচিগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি। ২০২০ সালে মানুষ কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তাতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অবদান সামান্য। আমাদের পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলে।

এবার আসা যাক অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও তার বাস্তবায়ন বিষয়ে। এসএমই ও অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনৈতিক অ্যাক্টরদের সহায়তার কথা বলা হয়েছিল। যদিও বরাদ্দ ছিল কম। এখানেও কণ্ঠশক্তি যাদের বেশি (পোশাক খাত বা অন্য বৃহৎ শিল্প) তাদের বরাদ্দও বেশি দেয়া হয়েছিল এবং তাদের ক্ষেত্রে প্রণোদনা বাস্তবায়নের গতিও অনেক বেশি ছিল। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে গতি ছিল মন্থর। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। অনানুষ্ঠানিক খাতে বরাদ্দপ্রবাহের বিষয়টি এখানেই আটকে গেছে। এসএমই ও কৃষি খাতে প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন আনুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনেক কম ছিল। সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে টার্গেটিং পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। কাজগুলো এনজিওর মাধ্যমে করা যেত। এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে পরামর্শ নেয়া কিংবা এনজিওকে ব্যবহারের বাড়তি উদ্যোগ দেখা যায়নি।

প্রথম দিকে ঢাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক সভায় ব্র্যাকসহ আরো কয়েকটি এনজিওকে ডাকা হয়েছিল। পরে আর ডাকা হয়নি তাদের। এক্ষেত্রে অবশ্য এনজিওগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে থেকে যতটুকু পেরেছে ততটুকু করেছে। এবার কিন্তু সেটিও হচ্ছে না। সামাজিক সহায়তা অবসন্ন। এ বিষয়ে উৎসাহও কম। গতবার যেমন অনেকেই মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সহায়তা দিতে। এবার সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই বলে মনে হচ্ছে। গত বছর পুরো বিষয়টিকে স্বল্পকালীন সমস্যা হিসেবে দেখেছে সবাই। তাই স্বল্পকালীন কিছু পদক্ষেপ দিয়ে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো শিক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

আমরা ১১-১২ হাজার কোটি টাকার মতো একটা প্রয়োজনের কথা বলেছিলাম। সেটাও তো একটা সীমিত সময়ের জন্য। আরো বেশি সময় ধরা হলে আরো বেশি অর্থের দরকার হবে। সেখানে বরাদ্দ  দেয়া হয়েছে ১-২ হাজার কোটি টাকার মতো। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। পুরো বিষয়টিকে স্বল্পকালীন ভাবা বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ একটু বাড়িয়ে দেয়া—এর বেশি কিছু নয়।

করোনায় সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে নগর দরিদ্রদের ওপর। সেখানে যে নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচি দরকার, সেদিকে সরকারের কোনো নজর নেই। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিপাকে পড়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুটি গ্রুপকে বিবেচনায় নিতে হবে। এক. আগে থেকে যারা দরিদ্র ছিল। দুই. এখন নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছে। প্রত্যেকের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন ধরনের। নতুনরা আগে দরিদ্র ছিল না, এখন দরিদ্র। সুতরাং তাদের জন্য যে সহায়তা কৌশল নেয়া দরকার, সেটি তাদের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করে নিতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো, সেখানে আগের প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এবারো ৩৫ লাখ দরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়া হবে। গত বছর কী হলো, সেই শিক্ষার কোনো বক্তব্য এখানে নেই। এখানেও দয়ার একটা ধারণা দেয়া হলো, এবারো দেয়া হবে। গতবারের ব্যর্থতার বিষয়গুলো কোথায় আসলে? এবারো যে পুরো বিষয়টি আগের মতো হবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়। খুব দ্রুত গত বছরের শিক্ষাটা সরকারের ধর্তব্যের মধ্যে আনা দরকার।

সার্বিক করোনা মোকাবেলায় সরকার আমলানির্ভর কৌশল গ্রহণ করছে। টপ-ডাউন একটা অ্যাপ্রোচ। এখানে সরকার ঐতিহাসিক একটি শক্তিকে উপেক্ষা করে এগোতে চাইছে। সেটি হলো কমিউনিটি সম্পৃক্ততা। বাংলাদেশের বহু অর্জন কিন্তু এর মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের মধ্যে কমিউনিটি সম্পৃক্ততাকে গৌণ ভূমিকায়ও আনার চিন্তাভাবনা জোরালোভাবে দৃশ্যমান নয়। কিছু হলেও তা মোটামুটি টোকেন পর্যায়ে রয়ে গেছে। সেজন্য এবারে বাড়তি আরেকটি বিষয় দাঁড়িয়েছে—সামাজিক সহায়তায় নিরাসক্তি। গতবারও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার অবদান গৌণ ছিল। মূল অবদান ছিল সামাজিক সহায়তা। সচ্ছল মানুষ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এবারের চিত্র বেশ অবসন্ন। যারা সহায়তা দেবে, তাদেরও সক্ষমতার কিছু ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় এ ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাদের যে একটা বড় ভূমিকায় নামা উচিত, সেটি উদ্বুদ্ধ করার বার্তাটিও পাওয়া যাচ্ছে না, যা হতাশাজনক। 

বাংলাদেশে সক্ষমতার ঘাটতি আছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু যে সক্ষমতা আছে, তার কার্যকর ব্যবহারে উৎসাহের ঘাটতি আছে। সমাজের মাঝে সক্ষমতার ঘাটতি নেই। অথচ রাষ্ট্রীয় ইচ্ছার ঘাটতি আছে, সেই সক্ষমতাকে ব্যবহার করার। এখানেই আমরা বারবার আটকে যাচ্ছি। নতুন অনেকেই দরিদ্র হয়েছে। তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্তির একটা বিষয় আছে। প্রথমে নগরিভিত্তিক আলাদা একটা কৌশল নেয়া দরকার। এর একটা স্বীকৃতিও দরকার। এখানে দুভাবে এগোনো যেতে পারে। শহরের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করে সুনির্দিষ্ট এলাকায়। তারা সারা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই। তাদের লোকালয়ভিত্তিক কনসেনট্রেশন আছে। তাদের ঘিরে দ্রুত একটা ম্যাপিং করা সম্ভব। অসম্পূর্ণ হলেও একটি ডাটাবেজ এখন আছে। গবেষক হিসেবে আমাদের বলা  হলেও দুই মাসের মধ্যে মোটামুটি কার্যকর একটা প্রাথমিক ডাটাবেজ তৈরি করা কঠিন নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে ইচ্ছার ঘাটতির সমস্যাটি অতিক্রম করতে হবে। নগর দরিদ্র, স্বল্প আয়ের মানুষের লোকালয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। হয়তো শতভাগ সঠিক হবে না সেটি, তবে মোটামুটি বড় চিত্রটি পাওয়া যাবে। সরকারি ভাষ্যে অস্বীকার করা হলেও গতবার কারচুপি হয়েছে। স্থানীয় সক্ষমতাকে ব্যবহার বা সম্পৃক্ত করা গেলে এক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে।  

দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাসকারী এলাকাগুলো মাথায় নিয়ে একটা তালিকা করা যেতে পারে। হয়তো তালিকারও দরকার নেই। ওখানে বসেই শতভাগ কভারেজ প্রদানের একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটি কৌশল হলো পেশাভিত্তিক সহায়তা প্রদান। যেমন রিকশাচালক। তাদের জন্য রিকশার গ্যারেজ আছে। এখানে শুধু বিবেচনায় রাখা দরকার, অর্থ যেন মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে না যায়। পরিবহন শ্রমিকদের সমিতি আছে। তাদের তালিকাও পাওয়া যাবে। কাজেই দুই পথেই সফল উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এক. এলাকাভিত্তিক এবং দুই. পেশাভিত্তিক। ছোট ছোট এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সুনির্দিষ্ট একটি কৌশলের মধ্যে সম্পৃক্ত করার ইচ্ছা সরকারের থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সামাজিক শক্তি ব্যবহারে সরকারের ইচ্ছার ঘাটতি। সরকার যেন আমলা ছাড়া সমাজকে ভয় পাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সমাজকে ভয় পেয়ে সমাজকে সহায়তা করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমলানির্ভর টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা জরুরি। বাস্তবায়নের জন্য যে উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ফলাফল। ফলাফল মিলছে কিনা, তা তদারক করা দরকার। এর ভিত্তিতে বাস্তবায়ন কৌশলের পরিবর্তন দরকার। সফল দেশের সরকারগুলো এভাবেই কাজ করে এবং করছে।

 ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি; চেয়ারপারসন, ব্র্যাক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন