বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-পদোন্নতি

নির্দেশিকা পরিপালনে শিক্ষকদের অনীহা কেন

ড. মো. সাইদুর রহমান

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৩ সালে এক বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আদেশ দেয়া হয়। সেগুলো হলো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সে অধ্যাদেশের বাইরে আলাদা করে অধ্যাদেশ দিয়ে পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রকৌশল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেন এবং কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে কৃষিবিদদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বাংলাদেশ অর্ধশতবর্ষে পদার্পণ করেছে, যার জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দেশের যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন হাজার ৬৪ ডলার, যার মধ্যে কৃষির অবদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি শতাংশের ওপর (করোনাকাল ব্যতিরেকে) দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অবদান নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই।  

উচ্চশিক্ষা প্রসারের কথা মাথায় রেখে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় পার্লামেন্টে পাস করা অধ্যাদেশ বলে এবং সরকার অনুমোদিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে মাত্র। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গবেষণায় মনোনিবেশ করে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে এবং তার দ্বারাই জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি পরিচিতি লাভ করে। কারণে একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখলে তারই প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়ন করতে হলে ইউজিসিকে সেই ভূমিকা নিতে হবে এবং প্রতি বছর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পূর্বনির্ধারিত সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয়াবলির ওপর ভিত্তি করে র্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে। একই সঙ্গে সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যথাযথ স্বীকৃতির ব্যবস্থা করলে এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে প্রতিযোগিতাও বাড়বে।

সে পথে না গিয়ে নির্দেশিকায় পদোন্নতির জন্য সময়কাল বাড়ানোর প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এছাড়া কিছু প্রকাশনা ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর/ইনডেক্সট জার্নালে থাকতে হবে, যার মানদণ্ড অত্যন্ত অস্পষ্ট। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের রেঞ্জ কোথায় তার উল্লেখ না করায় প্রমাণিত হয় যে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধার বা গবেষণার গুরুত্বকে মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ উন্নত বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার মূল্যায়নই বেশি হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞান এবং গবেষণায় ভালো অবদান রাখতে পারলে স্বল্প সময়ে পদোন্নতি পাওয়ার (সহকারী প্রফেসর থেকে প্রফেসর) উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে। যারা গবেষণায় নিয়োজিত আছেন, তাদের জন্যও একই বিবেচ্য হওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার সঠিকভাবে বিদ্যমান জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার দক্ষতা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চর্চা করার সুযোগ না হলে আর কোথাও হবে বলে আশা করা যায় না। দেশের উন্নয়নে কারো অবদান কম নয়। তবে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, উন্নত প্রযুক্তি সভ্য সংস্কৃতি সমৃদ্ধ উন্নত জাতি গঠনে উন্নত শিক্ষার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আবারো বলছি সম্পদ থাকলে তা উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাড়ানো যায়। আর জনশক্তি উন্নত ব্যবস্থাপনার মূল শক্তি, যার সর্বোচ্চ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়।

আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলে ভুল হবে। তা হলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়টি বাদ দিয়ে শুধু শিক্ষকদের নিয়োগ পদোন্নতিতে মনোযোগী হওয়ায় মনে হয়েছে এটা একটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সত্যিই তা করা যাবে, তবে তাতে মঙ্গল কতটুকু হবে এটি ভেবে দেখার বিষয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বায়ত্তশাসন চর্চা বৃদ্ধি করা হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। তা দিব্যি করে বলা যায়। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেকেই অবৈধভাবে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। অবশ্যই অন্যায় চর্চা প্রতিহত করা দরকার এবং তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সঠিক শিক্ষককেই খুঁজে নেয়া দরকার। সে জায়গায় বেশি মনোযোগী হলে দেশ সমাজ অধিকতর উপকৃত হবে।

বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। ফলে ইদানীং ব্রেইন-ড্রেইন কথাটা খুব শোনা যাচ্ছে। এটি আর কিছুই না, সব ক্ষেত্রে মেধাবীরা উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত দেশে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসার উৎসাহ পাচ্ছেন না। অথচ চিত্রটিই চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশের জন্য সত্য নয়। তাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশ থেকে উন্নত শিক্ষা প্রযুক্তি আয়ত্ত করে দেশে ফিরে দেশের শিক্ষা প্রযুক্তিকে উন্নত করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশে মেধার মূল্যায়ন পাচ্ছেন না বলে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আর্থিক, সামাজিক, দেশপ্রেম, পারিপার্শ্বিকতা সবকিছুই এজন্য দায়ী। আমাদের উচিত হবে সেগুলো খতিয়ে দেখা এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা, যাতে মেধাবীরা দেশের কল্যাণে নিয়োজিত হন।

প্রকৃত কারণ জানা না থাকলেও এটি লক্ষণীয় যে শিক্ষার্থীদের সব আকর্ষণ বিসিএস ক্যাডারের চাকরি এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে প্রশাসন ক্যাডারের চাকরি। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদসহ সব বিষয়ের ভালো ফল অর্জনকারী মেধাবীরা ঝুঁকছেন প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পাওয়ার জন্য। এটি কি কোনো একটি উন্নত দেশের জনশক্তি তৈরির জন্য আদৌ প্রত্যাশিত? অন্যান্য শ্রেণী-পেশায় নিয়োজিতদের ওপর প্রভাব বিস্তার, প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ দেখানো এবং তার কারণে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি বাদ দিলে এর পক্ষে আর কী কারণ দেখানো যাবে তা মোটেও বোধগম্য নয়। অথচ সব সুবিধা তাদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। একথা সহজেই অনুমেয় যে উচ্চশিক্ষায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কৌশল নিতে অভিন্ন নির্দেশিকার বাস্তবায়ন হলো তার প্রাথমিক ধাপ। প্রশাসনসর্বস্ব ধারণা থেকে সেবাধর্মী ধারণায় আমাদের আসতেই হবে। আর সেক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন হওয়া উচিত সর্বাগ্রে। সুতরাং দক্ষ উন্নত জনশক্তি এবং জাতি গঠনের মূলে আমাদের যেখানে যেতে হবে, তা হলো স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে। সর্বোচ্চ মেধাবীদের শিক্ষাদানে এবং গবেষণায় নিয়োজিত করার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও এখানে অনিবার্য। তাই আগের ন্যায় সিনিয়র অভিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সর্বোচ্চ বেতন স্কেল পাওয়ার বিধান রাখা জরুরি।

পরিশেষে বলতে চাই, উন্নত মানের শিক্ষা গবেষণা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োজিত করে মানসম্মত গ্র্যাজুয়েট তৈরি উচ্চমানের গবেষণা করাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এজন্য শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করা উচিত, যাতে অন্য কোনো পেশার সঙ্গে তাদের তুলনা করার বিষয়টি মোটেও না আসে। সব কাজে দক্ষ প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এটা সবারই প্রত্যাশা। আর প্রশাসনের দক্ষ জনবল তৈরি করার সূতিকাগারও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল প্রকৃত শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। আসুন সেদিকে নজর দিই এবং যারা জ্ঞান সৃষ্টি করে তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্মান করি। আর এর একটি সংস্কৃতি তৈরি করি। দীর্ঘদিন চর্চা অব্যাহত রাখলেই কেবল উন্নত জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনা তৈরি হবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে প্রত্যাশা সবার। তার জন্য উন্নত জ্ঞান সৃষ্টি এবং তা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ফিরতে হবে শিক্ষকসমাজের কাছেই এবং সে পেশায় মেধাবীদের আকর্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসার এখনই সময়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সে লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে এবং দিতে হবে প্রভাবমুক্ত কার্যকর স্বায়ত্তশাসন। সে কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া নির্দেশিকার বাস্তবায়ন মানতে চান না।

 

. মো. সাইদুর রহমান: অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন