করোনা সংক্রমণের তীব্রতা রোধ

প্রবেশমুখগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় দেশে চলছে লকডাউন। লকডাউনে সীমিত হয়েছে অভ্যন্তরীণ চলাচল। এতে সংক্রমণ মৃত্যু কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু সমস্যা রয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবেশমুখগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এক্ষেত্রে বিরাজ করছে ব্যাপক শিথিলতা। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্স (ডিটিএম) রিম্যাপ প্রতিবেদনে দেশের মোট ২৩টি আন্তর্জাতিক প্রবেশমুখের বেশির ভাগই করোনাকালে অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত থাকার তথ্য উঠে এসেছে। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য সাংঘাতিক উদ্বেগজনক। প্রবেশমুখগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকছে। কাজেই বিষয়টি গভীরভাবে আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য।

গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পরের কয়েক মাস প্রবেশমুখগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন বন্দরগুলোর কার্যক্রম ছিল বেশ নিয়ন্ত্রিত। তবে সংক্রমণ কমে এলে আগস্টের দিকে বন্দরগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা তৈরি হয়। তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল মাত্র তিনটি বন্দরের। বেশির ভাগেরই কার্যক্রম চালু ছিল আংশিক পুরোপুরি। এখনো ধরনের শৈথিল্য বিরাজমান। ভারতীয় সীমান্তগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা করা হলেও কার্যত সবকিছু সচল। বেনাপোল, হিলিসহ স্থলবন্দরগুলোয় চলছে পণ্য পরিবহন। পরিবহনসংশ্লিষ্ট লোকজন সাধারণ যাত্রীদের নিত্য আসা-যাওয়ার খবর মিলছে। স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বালাই নেই। কার্যকর ব্যবস্থা নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন আইসোলেশনের। এটা সংক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে পারে বৈকি। তাই অভ্যন্তরীণ চলাচলের পাশাপাশি বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ বিশ্বব্যাপী কভিডের বিস্তার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ পদ্ধতি অনুসরণে সাফল্য পেয়েছে। যখনই সংক্রমণ বেড়েছে, তখনই দেশগুলো অভ্যন্তরীণ চলাচলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এতে তারা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদের অনুসরণে আমাদের দেশেও প্রথম দিকে ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়নে শিথিলতা জনসচেতনতার অভাবে সেগুলো কার্যকর করা যায়নি। বিশেষ করে কোয়ারেন্টিন আইসোলেশন নিশ্চিত করা যায়নি। বিমানবন্দরের যাত্রীদের প্রথমদিকে কিছুটা কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা গেলেও অন্য বন্দরগুলোয় তাও পারা যায়নি। সরকারি তরফে চেষ্টা করা হলেও যাত্রীসাধারণ বিধিনিষেধ মানেনি। ফলে দেশে কভিড পরিস্থিতির বেশ উন্নতি ঘটার পরও ফের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

স্বস্তির বিষয় যে চলমান প্রায় এক মাসের লকডাউনে সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রবেশমুখগুলো অনিয়ন্ত্রিত থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী জুন থেকে দেশে আবার করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখন থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতে সংক্রমণ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড গড়ছে, মারা যাচ্ছে গড়ে তিন হাজারের বেশি লোক। নেপালেও সংক্রমণ বাড়ছে। অবস্থায় স্থল সমুদ্রবন্দরসহ সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা বাড়াতে হবে। সরকার ভারতের সঙ্গে এখন সব সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু স্থলবন্দরগুলোয় কার্যক্রম চলছে। পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে ভারতীয় চালকরা আসছেন আমাদের দেশে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশছেন, গল্পগুজব করছেন। মাস্ক পরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করছেন। এদিকে বন্দরসংলগ্ন এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনেরও সুব্যবস্থা নেই। অন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থারও ঘাটতি রয়েছে। এসব বিষয় জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এরই মধ্যে দেশে ভারতীয় ধরন শনাক্তের খবর মিলছে। এটা মারাত্মক ভীতিপ্রদ। তাই সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে দেশের প্রবেশমুখগুলোয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিকল্প নেই। প্রয়োজন হলে সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনতে হবে।

লক্ষণীয়, গত বছরের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে সংক্রমণ যাতে না বাড়ে সেজন্য চলমান বিধিনিষেধ আগামী ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। ঈদের ছুটি তিনদিন নির্ধারণ করে সব চাকরিজীবীকে কর্ম এলাকায় থাকার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও থেমে নেই ঈদ যাত্রা। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও রাজধানী শহরের সীমানা পর্যন্ত চলাচল করছে সিটি বাস। প্রতিটি জেলার সীমানা পর্যন্ত ওই জেলার বাসও চলছে। সুযোগ নিয়ে অন্যবারের চেয়ে এবার আগেভাগেই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষ যাচ্ছে প্রাইভেট কার মাইক্রোবাস ভাড়া করে। আবার নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকা ছাড়ার পরই ব্যবহার করছে নছিমন, করিমনসহ স্থানীয় পরিবহন। সব মিলিয়ে চিত্রটি এমন যে দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বন্ধ রেখেও মানুষের গ্রামে ফেরা ঠেকানো যাচ্ছে না। নানা কায়দায় ছুটছে তারা। মানুষ যেভাবে গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করছে, তাতে সংক্রমণ বাড়ার যথেষ্ট শঙ্কা থেকে যায়।

একই অবস্থা রাজধানীসহ বড় শহরের বিপণিবিতানগুলোয়ও। সেখানে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট, বিপণিবিতান খোলার নির্দেশ দেয় সরকার। তবে বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক পর্যন্তই স্বাস্থ্যবিধির দৌড়। আর বাকি স্বাস্থ্য নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করছে না তারা। এটাও সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ার কারণ হতে পারে। সরকার থেকে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ পালনের কথা বলা হলেও কার্যত বিধিনিষেধ চলছে ঢিমেতালে। শুধু বিধিনিষেধ আরোপ করলে হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। গত এক বছরে আমাদের বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয়গুলো আমাদের জানা। সেগুলোর যথার্থ বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন