টিকাদানে পিছিয়ে পড়া মানে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়া

শিহাবুল ইসলাম

কভিড-১৯ মহামারীতে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় বিশ্ব। চলাচল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যায় সবকিছু। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে অনেক লোক ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ে। এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে আলোর দিশা হিসেবে হাজির হয় কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা। তবে টিকার খবরে আমরা যতটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম- তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আগে থেকে সতর্ক করে আসা টিকা জাতীয়তাবাদই পুরো বিশ্বে রূঢ় বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। 

ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের দ্রুত টিকা দিতে পারলেও পিছিয়ে পড়েছে অনুন্নত দেশগুলো। যেমন এরইমধ্যে এক তৃতীয়াংশ মার্কিন নাগরিককে পুরোপুরি (দুই ডোজ) টিকা দেয়া শেষ হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। অন্যদিকে আফ্রিকার মাত্র শতাংশের কিছু বেশি মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কেবল দশমিক শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত ডোজ পাওয়া গেছে এবং শতাংশ মানুষকে পুরোপুরি (দুই ডোজ) করোনার টিকা দেয়া হয়েছে।

সুতরাং টিকাদান কার্যক্রমের এই যখন পরিস্থিতি তখন বিশ্বজুড়ে নতুন এক বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কা। ব্যবসা-বাণিজ্য ভ্রমণে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা। টিকাদান কার্যক্রমে অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য পর্যটন শুরু হচ্ছে। এতে করে দেশগুলোর অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেমন জোরদার হবে, তেমনি পুনরুদ্ধারের গতিও ত্বরান্বিত হবে। আর এক্ষেত্রে টিকাদানে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোও দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একদিকে বৈশ্বিক প্লাটফর্ম থেকে ছিটকে পড়ে দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীর হবে। পাশাপাশি দেশগুলোতে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধ্বংসাত্মক প্রভাবও অব্যাহত থাকবে। ফলে প্রভাবগুলো মোকাবেলায় দ্রুত টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।

সুতরাং করোনাভাইরাস এখন আর কেবল স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে টিকে থাকাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ায় মার্কিন পর্যটকদের কাছে টানতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মার্কিন নাগরিকরা যাতে কোয়ারেন্টিন বিধি ছাড়াই ইউরোপের যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারে সম্প্রতি তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই ভ্রমণ শুরু হবে বলে আশাবাদী খোদ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন। তিনি বলেছেন, ভ্রমণ পুনরায় শুরু করা মহামারীর পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হচ্ছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। কারণে টিকা নেয়া মার্কিন নাগরিকদের ইউরোপে ভ্রমণ করতে দেয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে আমরা সদস্য দেশগুলোকে প্রস্তাব দিচ্ছি।

আর এমনটা হলে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইইউর মধ্যে নতুন করে বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে। পর্যটকরা ইউরোপের অর্থনীতিকে কয়েকগুণ দ্রুত পুনরুদ্ধারে অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির খবরেই বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। সর্বশেষ গত মে থেকে বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল, শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানিদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রটি। এর আগে ২৭ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ ভারত থেকে যাত্রী প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ইতালি। এসব নিষেধাজ্ঞা ক্ষণস্থায়ী হলেও টিকাদান কার্যক্রম সম্পূর্ণ হওয়ার পরের নিষেধাজ্ঞাগুলো স্থায়ীও হতে পারে।

আবার টিকাকরণ শেষে করা দেশগুলোর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে করোনার নতুন স্ট্রেইন। সুতরাং দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই নাগরিকদের সুরক্ষিত করতে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে চাইবে। টিকা নেয়া পর্যটকরাও এমন কোনো দেশে ভ্রমণ করতে চাইবেন না, যেখানে টিকাদান কার্যক্রমের হার কম। যেমন, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ দেশে নাগরিকদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে।

তবে আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা চাইলেই এখনই সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে পারবো না। ব্লুমবার্গের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার মোট ১২৫ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া গেছে। দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র দশমিক শতাংশ মানুষকে পুরোপুরি টিকা দেয়া সম্ভব। এর মানে হলো বিশ্বের ৯২ শতাংশ মানুষের জন্যই এখনো টিকা পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি এটা আমরা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছি। অনেক দেশের আগেই গত ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। তবে তিন মাস যেতে না যেতেই কার্যক্রমটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার আগাম অর্থ পরিশোধ করেও বাংলাদেশ টিকা পাচ্ছে না। কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি হলেও ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহ করে নানা অজুহাতে টিকা পাঠানো বন্ধ রেখেছে সেরাম। আগামী জুন-জুলাইয়ের আগে টিকা সরবরাহ অনিশ্চিত বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এমন পরিস্থিতিতে বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকার স্থগিত করেছে টিকা নিবন্ধন কার্যক্রম। শিগগিরই টিকা না এলে প্রথম ডোজ দিয়েছেন এমন প্রায় ১৫ লাখ জনের দ্বিতীয় ডোজপ্রাপ্তি নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এজন্য সেরাম নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে সরকার এখন অন্যান্য উত্স থেকে টিকা পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে।

খুব শীগগিরই রাশিয়া চীন থেকে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া সম্পূর্ণ করতে বাংলাদেশের এখনো ১৫ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই লাগবে। কারণ দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য কোনো সংস্থার টিকা দেয়ার বিষয়টি এখনো পরীক্ষিত নয়। আবার টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আমাদের এখনো প্রচুর টিকার সংস্থান করতে হবে। তাই দুই-একটি দেশ কিংবা সংস্থার ওপর ভরসা করে থাকার সময় এখন নয়।

সেজন্য সরকারকে বিভিন্ন উত্স থেকে কভিড-১৯ টিকার সন্ধান করতে হবে। সেটা হতে পারে ভারত, চীন, রাশিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র টিকা মজুদ করে রেখেছে- বিশ্বজুড়ে এমন সমালোচনার মধ্যে গত মাসের শেষ দিকে টিকা রফতানির ঘোষণা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ছয় কোটি ডোজ টিকা রফতানি করবে দেশটি। সুতরাং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেতে এটাও আমাদের জন্য ভালো সুযোগ হতে পারে।

তাছাড়া করোনার মহামারী মোকাবেলায় দুই ডোজ টিকাই শেষ কথা নয়। কভিড-১৯ টিকা প্রস্তুতকারক ফাইজার জানিয়েছে, শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে আগামী তিন বছরে বার্ষিক বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হবে। সে অনুযায়ী ডোজটি কেমন হতে পারে- তা নিয়ে প্রস্তুতিও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সুতরাং টিকা নিয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে যতটা দেরি হবে মহামারী মোকাবেলা বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়বো।

লেখক: সংবাদকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন