করোনাবিধ্বস্ত বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আশা-ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ভারত। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কভিডের টিকা সরবরাহের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপরই নির্ভর করেছিল দেশগুলো। কিন্তু কাঁচামাল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির স্থানীয় চাহিদাই মেটাতে পারছে না সেরাম। অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও টিকা রফতানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় টিকার জন্য এখন বেইজিং ও মস্কোর ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো। দেশ দুটিও এখন অকাতরে টিকা বিলিয়ে যাচ্ছে। এমনকি লাইসেন্সিংয়ের ভিত্তিতে টিকার প্রযুক্তিও ভাগাভাগি করছে।
যদিও শুরুর দিকে চীন ও রাশিয়ার টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ছিল খুব কম। পশ্চিমা গণমাধ্যমও দেশ দুটির টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নানা প্রতিবেদন-নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো তাদের সংগৃহীত টিকা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি খুব একটা ইচ্ছুক নয়। এ অবস্থায় প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ভারত।
করোনার টিকা বাজারে আসার আগে থেকেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভারতকেন্দ্রিক প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। এসব দেশে সুলভে সরবরাহের শর্তে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছিল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। এর বাইরেও দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গঠিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতেও টিকা সরবরাহের কথা ছিল ভারতের। এর ভিত্তিতেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও গত বছরের অক্টোবরে বলেছিলেন, বৈশ্বিক ফার্মেসিতে রূপ নিতে যাচ্ছে ভারত। এ অনুযায়ী চলতি বছরের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশে এ টিকা বিনা মূল্যেও পাঠিয়েছে দেশটি। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী দেশটির এক ধরনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। ওই সময় ডব্লিউএইচওর মহাসচিব টেড্রোস অ্যাডহ্যানম গেব্রেইসুসও জানুয়ারিতে এক টুইট বার্তায় ‘বৈশ্বিক কভিড-১৯ মোকাবেলায় সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য’ ভারত ও নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত এ সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তোলে। এ অবস্থায় ভারত টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। এমনকি টিকা ক্রয় বাবদ আগাম অর্থ পরিশোধ করে রাখা দেশগুলোতেও সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সেরাম।
অন্যদিকে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল টিকার সংকট চীন ও রাশিয়ার সামনে বড় ধরনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহারও করে দেশ দুটি। বর্তমানে নিজ নিজ টিকাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে বেইজিং ও মস্কো। একই সঙ্গে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজস্ব সক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি নিজেদের পরিত্রাতা ভাবমূর্তি তৈরিতেও সফল হয়েছে চীন ও রাশিয়া।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে টিকা সরবরাহ করেছে চীন। এর মধ্যে একেবারে বিনা মূল্যে টিকা পেয়েছে ৫৩টি দেশ। এ তালিকায় যেমন আফ্রিকার দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ফিলিপাইন ও পাকিস্তানের মতো এশিয়ার ভূরাজনীতিতে কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন দেশও। এছাড়া দেশটি থেকে টিকা ক্রয় করেছে ২৭টি মধ্যম আয়ের দেশ। টিকার এ কূটনীতির মাধ্যমে করোনার উত্পত্তিস্থলের বদনাম অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছে চীন। এর পরিবর্তে নিজের মহামারী থেকে পরিত্রাণকারীর ভাবমূর্তি তৈরিতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে দেশটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত এখন নিজেই নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমারাও এখন এ বিষয়ে নিজেদের ছাড়া অন্য কিছু ভাবছে না। ফলে বিশ্বের দরিদ্রতম ও সবচেয়ে নাজুক জনগোষ্ঠীগুলো এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। এ অবস্থায় টিকার সরবরাহ শূন্যতা পূরণের জন্য বেইজিংয়ের প্রতিই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। তাছাড়া চীন নিজেও বেশ কঠোর ও সফলভাবে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে ভ্যাকসিন সরবরাহের মাধ্যমে দেশটির স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় চাপ পড়ার সম্ভাবনা খুব কম।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি দাবি করেছেন, বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণের জন্যই এসব টিকা সরবরাহ করছে চীন। যদিও এর বড় একটি অংশ বিনা মূল্যে পাচ্ছেন না গ্রহীতারা। এজন্য কয়েকটি দেশকে চীনা ভ্যাকসিন নির্মাতাদের বড় অংকের অর্থও পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি দেশের যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ নির্মিত ফাইজার ও মডার্নার টিকা গ্রহণে আগ্রহ তুলনামূলক বেশি। কিন্তু প্রবেশাধিকার না পেয়ে চীনা টিকার দিকেই হাত বাড়াতে হয়েছে দেশগুলোকে।
এছাড়া চীনা কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিনের প্রযুক্তি ভাগাভাগি বা লাইসেন্স বিতরণ নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি নেই। যদিও পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে উল্টো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বায়োফার্মা এরই মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক উদ্ভাবিত টিকার (করোনাভ্যাক) আঞ্চলিক হাব হয়ে উঠেছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, করোনা টিকা কূটনীতির এ সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে চীন। বিশেষ করে এটিকে কাজে লাগিয়ে উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে দেশটি। এপ্রিলের থিংক গ্লোবাল হেলথ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ওই সময় পর্যন্ত বিশ্বের ৫৬টি দেশে টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি ছিল চীনের। এর মধ্যে একটি বাদে বাকি সবগুলোই দেশটির বিআরআই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী।
টিকাকেন্দ্রিক কূটনীতিতে ভারতের ব্যর্থতা ও পশ্চিমা দেশগুলোর অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়েছে রাশিয়াও। চীনের মতো মস্কোও এখন করোনার টিকাকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিছক ভাবমূর্তি তৈরি নয়, বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা ও প্রভাব জানান দেয়ার কাজেও স্পুটনিক ৫ টিকাকে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে টিকা সংগ্রহে ব্যর্থ দেশগুলোও রাশিয়াকে দেখছে প্রয়োজনের সময়ে এগিয়ে আসা বন্ধু হিসেবে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখার মাধ্যমে রাশিয়া বর্তমানে আবারো নিজের সক্ষমতার জানান দিতে চাইছে। একই সঙ্গে বিষয়টিকে নিজেকে আবারো বিশ্বের বড় সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবেও দেখছে দেশটি। এছাড়া পশ্চিমা উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে ব্যর্থ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রভাব বাড়ানোর ক্ষেত্রেও দেশটির ভ্যাকসিন কূটনীতি বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে লাইসেন্সিংয়ের ভিত্তিতে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের সঙ্গে স্পুটনিক ৫ টিকার প্রযুক্তি ভাগাভাগি করছে রাশিয়া। দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে আর্জেন্টিনা এরই মধ্যে টিকাটির উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। এছাড়া যেসব দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই, সেগুলোয় টিকার চালান পাঠাচ্ছে ক্রেমলিন। আফ্রিকান ইউনিয়ন জানিয়েছে, এরই মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৩০ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে আঞ্চলিক সংস্থাটি। এমনকি চীন, ব্রাজিল, ইরান ও সার্বিয়াতেও স্পুটনিক ৫ উৎপাদন নিয়ে কয়েকটি চুক্তি এরই মধ্যে চূড়ান্তও হয়েছে।