বাজেট বাস্তবায়নে তিন স্তরের কমিটি করছে সরকার

মেসবাহুল হক

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপকল্প ২০৪১ গ্রহণ করেছে সরকার। সে অনুযায়ী প্রতি বছরই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে বড় আকারের বাজেট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত হারে না হওয়ায় রূপকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে সরকার। সেজন্য বাজেট প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত মনিটরিংয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা সংস্থার তিনটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, কমিটিগুলোর কার কী কাজ হবে, তা নির্ধারণ করে দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পরও কাজে গতি না এলে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোকে জবাবদিহি করতে হবে।

এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাজেট ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ বা অধিশাখা বা শাখা, বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটি বাজেট ওয়ার্কিং গ্রুপের কার্যপরিধি সংশোধনে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। আগামীকাল দুপুরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অর্থ বিভাগ ভার্চুয়ালি বৈঠক করে কার্যপরিধি চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরের বাজেট বাস্তবায়নের হার আশানুরূপ নয়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৭৯ দশমিক শতাংশ। আবার চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কিন্তু ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে এখন থেকেই শতভাগ বাজেট বাস্তবায়নের দিকে এগোতে হবে। তাই বাজেট বাস্তবায়ন বাড়াতে কঠোর হচ্ছে সরকার।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে দুটি করে কমিটি তাদের বাজেট প্রণয়ন বাস্তবায়ন মনিটরিং করে। ২০১২ সালে অর্থ বিভাগ পরিপত্র জারি করে তাদের কর্মপরিধি ঠিক করে দিলেও কমিটিগুলোর কাজ তেমনভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তাই বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার বিষয়টি এলে তারা ছাড় পেয়ে যায়।

এমন পরিস্থিতিতে নতুন কার্যপরিধি খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা কার্যকারিতা বাড়াতে পর্যায়ক্রমে সব মন্ত্রণালয় বিভাগ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) পদ্ধতির আওতায় আনা হবে। যার উদ্দেশ্য হলো বাজেট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য তাদের অধিকতর কর্তৃত্ব দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।

এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৩ জুন অর্থ বিভাগ থেকে জারীকৃত পরিপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাজেট ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ বা অধিশাখার কাজে অভিন্নতা আনা হয়। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে গত আট বছরে সরকারের কৌশলগত লক্ষ্য উদ্দেশ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা স্বচ্ছতা আনা এবং সেবাগ্রহীতার কাছে নির্বিঘ্নে সব ধরনের আর্থিক সেবা পৌঁছার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগ সম্প্রতি কিছু পদ্ধতিগত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করেছে এবং ধরনের বিশেষ কিছু কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

অর্থ বিভাগ বলছে, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্তসহ দেশকে উচ্চ আয়ের উন্নত দেশের মর্যাদায় উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। লক্ষ্যগুলো অর্জনসহ ২১০০ সালের মধ্যে -দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে সামনে রেখে সামাজিক খাতে উত্তরোত্তর ব্যয় বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, দারিদ্র্য নিরসন জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণে সরকারের স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি-কৌশলের সঙ্গে বাজেট কাঠামোর সংযোগ সে অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কমিটি, দপ্তর বা সংস্থার জন্য সংশোধিত কার্যপরিধি প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খসড়ায় প্রতিটি কমিটির সদস্য সংখ্যা, কাকে সভাপতি করা হবে, কমিটির কাজ কী হবে ইত্যাদি সবকিছুই নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।

খসড়ায় মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠনের ক্ষেত্রে বলা হয়, সচিব বা প্রধান হিসাবদানকারী অফিসারকে সভাপতি করে ১০ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বাজেটের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি, যেমন বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১), অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫), টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, বাংলাদেশ -দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০, মন্ত্রণালয় বা বিভাগ-সম্পর্কিত নীতি-পরিকল্পনা, সংশ্লিষ্ট খাতভিত্তিক নীতি-পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বাজেট কাঠামো অনুমোদন করা হবে।

কার্যপরিধির বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, কমিটি রাজস্ব বাজেট থেকে অর্থায়নকৃত উন্নয়ন কর্মসূচির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে অনুমোদন করবে। সচিবালয় এবং সংযুক্ত বা অধীন দপ্তর বা সংস্থার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যয়সীমা অনুমোদন করবে। রাজস্ব আয় প্রাপ্তি, পরিচালন উন্নয়ন ব্যয়ের প্রাক্কলন প্রক্ষেপণ অনুমোদন করা। উন্নয়ন অনুবিভাগ বা পরিকল্পনা শাখার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে মাসিক ভিত্তিতে বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণের অগ্রগতি এবং অধিদপ্তর বা সংস্থাওয়ারি সব কার্যক্রম বা কর্মসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাজেট বরাদ্দ অপেক্ষা অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ যাতে বেশি না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হবে।

প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ . এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যে বরাদ্দ দেয়া হয়, সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অনেক বেশি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এতে প্রকল্পপ্রতি বরাদ্দ কমে যায়। বরাদ্দ কম দেয়ার ফলে প্রকল্পের সময় বেড়ে যায়, আর সময় বাড়লে ব্যয়ও বাড়ে। তাছাড়া যে বরাদ্দটা দেয়া হয়, সেটাও বাস্তবায়ন হয় না। দেখা যায়, প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয় ৪০ শতাংশ। শেষের দিকে এটা তাড়াহুড়ো করে ৯০ থেকে ৯২ শতাংশে উন্নীত করা হয়। তখন কাজ ঠিকমতো হয় না, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো কাজ না করেই বাস্তবায়ন হয়েছে বলে লিখে দেয়া হয়। ফলে এডিপি থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল আমরা পাই না। সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা বাড়িয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পাশাপাশি যে প্রকল্পগুলো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন