ভারতের কভিড ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নিউ ইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট

বণিক বার্তা অনলাইন

নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট থেকে ৮ হাজার ৩০০ মাইল পূর্বে ভারতরে বেঙ্গালুরুর আউটার রিং রোডের অবস্থান। তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে পথের দূরত্ব কোনো বিষয় নয়। তাই এ রিং রোডেই ছিল বৈশ্বিক আর্থিক শিল্প খাতের প্রাণকেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাক অফিস।

মহামারীর আগে আউটার রিং রোডের কাঁচ আর স্টিল দিয়ে তৈরি সুউচ্চ ভবনগুলো মুখর ছিল কর্মীদের পদচারনায়। বিখ্যাত গোল্ডম্যান শ্যাচ গ্রুপ ইনকরপোরেশন, ইউবিএস গ্রুপসহ বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শাখা অফিস ছিল এখানে।

করোনাভাইরাসজনিত মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে কঠিনভাবে আঘাতের পর বদলে গেছে দৃশ্যপট। আউটারের রিং রোডের সারি সারি ভবনগুলো খালি। ওয়াল স্ট্রিটের ভারতীয় অফিসগুলোর কাজ চলছে কর্মীদের বাড়িতে বসে। বেঙ্গালুরুতে বেড়েছে সংক্রমণের হার। ফলে বেশিরভাগ কর্মীই অসুস্থ বা পরিবার-পরিজনদের জন্য অক্সিজেনসহ অন্যান্য চিকিত্সা সরঞ্জাম জোগাড়ে ব্যস্ত। ফলে ব্যাক অফিসের কাজের ওপর এর প্রভার পড়েছে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড পিএলসি গত সপ্তাহে জানিয়েছে যে, ভারতে তাদের ২০ হাজার কর্মীর মধ্যে ৮০০ জন নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ইউএসবি গ্রুপের অন্তত ২৫ শতাংশ কর্মী ছুটি নিয়েছেন। এর মধ্যে দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওয়েলস ফারগো অ্যান্ড কোং কর্তৃপক্ষ। তাদের বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের অফিস থেকে কো-ব্র্যান্ডেড কার্ড, ব্যালান্স ট্রান্সফার ও রিওয়ার্ড প্রোগ্রামের মতো কাজগুলো কোনোমতে চলছে।

ব্যাংকগুলো যথাসম্ভব ঝামেলা ছাড়াই তাদের মূল কাজগুলো অন্য এলাকায় স্থানান্তর করে ফেলেছে। তবে ভারতে সংক্রমণের উচ্চহার সেইসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে যারা কয়েক দশক ধরে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। টিকাদান কর্মসূচির কারণে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হচ্ছে, সেখানে ভারতে তীব্রতর হচ্ছে সংক্রমণের মাত্রা। ফলে ওয়ালস্ট্রিটের ব্যাক অফিসগুলি আবারো আগের মতো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আবার এতো কম সংখ্যক কর্মী দিয়ে কীভাবে আউটসোর্সির প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ চালিয়ে নেবে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

রিসার্চার গার্টনার ইনকরপোরেশনের বিশ্লেষক ডি ডি মিশ্রা বলেন, এটি কেবল ভারতের একার সমস্যা নয়। সমস্যাটি আসলে বৈশ্বিক। করোনার বর্তমান ঢেউটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বড় হতে যাচ্ছে। যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভারতে কর্মী আছে তাদের উচিত প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। তিনি বলেন, প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য উদ্বিগ্ন গ্রাহকের টেলিফোন পান তারা। যেখানে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়।

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই কোটি ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। যার অর্ধেকই বেঙ্গালুরু শহরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের সপ্তাহে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। বেঙ্গালুরু, দিল্লি ও মুম্বাইতেই মূলত বিশ্বের বড় আর্থিক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা অফিস অবস্থিত। এসব শহরে সংক্রমণ এতোই বেড়েছে যে স্থানীয় সরকার চলাচলের ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সব মিলিয়ে সংকটে পড়েছে ভারতের অর্থনীতি। সবশেষ ঢেউয়ের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০টির বেশি খাত। যেগুলো ছিল মূলত আউটসোর্সিং ভিত্তিক। ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের একটা বড় অংশ হলো ইংরেজিভাষী ও প্রযুক্তির দিক থেকে দক্ষ।

এখন ব্যাক অফিসগুলো খণ্ডকালীর কর্মীদের দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। অথবা কর্মীদের একাধিক ভূমিকায় কাজ করতে বলছে। কর্মীদের দিয়ে ওভারটাইম করানো হচ্ছে, কম অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলোর কাজ মুলতবি করা হয়েছে। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে কর্মীদের।

ওয়েলস ফার্গোর এক কর্মী বলেন, কিছু কাজ ফিলিপাইনে চলে যাচ্ছে। যেখানে কর্মীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাতভর কাজ করছেন। সানফ্রানসিসকোভিত্তিক ব্যাংকটির ভারতে ৩৫ হাজার কর্মী আছে। যারা যানবাহন, বাড়ি ও ব্যক্তিগত ঋণের বিষয়ে কাজ করেন। পাশাপাশি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ, অ্যাকাউন্ট খুলতে গ্রাহকদের সহায়তা করেন ও অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত যে কোনো সেবা দিয়ে থাকেন।

ইউএসবির এক কর্মী জানিয়েছেন, মুম্বাই, পুনা ও হায়দ্রাবাদ মিলে তাদের ভারতে প্রায় আট হাজার কর্মী এখন অনুপস্থিত। ফলে সেখান থেকে কাজ চলে যাচ্ছে পোল্যান্ডের মতো দেশে। ব্যাংকটির ভারতের কর্মীরা ট্রেড সেটেলমেন্ট, বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে সহায়তা ও সম্পদ পরিচালনায় সহায়তা করেন। এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন ইউএসবি বা ওয়েলস ফার্গো কর্তৃপক্ষ।

সবমিলিয়ে বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এ আউটসোর্সিং খাতটি। তবে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিল উইন্টার বলেন, কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা যায় সেদিকে গভীর মনোযোগ দিচ্ছি আমরা। তিনি এটাও উল্লেখ করে যে, তাদের কিছু কাজ কুয়ালালামপুর, তিয়ানজিন ও ওয়ারসো তে স্থানান্তর করা হয়েছে। বার্কলেস পিএলসির সিইও জেস স্টেলি বলেছেন, তারাও কিছু কাজ ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর করেছেন। ব্যাংকটির ভারতে রয়েছে ২০ হাজার কর্মী।

তবে গতবছর ভারতে লকডাউন ঘোষণার পর অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করা সুযোগ দিয়েছিল। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শতভাগ কাজ বাড়িতে বসে হচ্ছে। যেমন গোল্ডম্যানের ভারতের হাজারো কর্মী বাড়িতে বসে কাজ করছেন। প্রয়োজনে দল বড় করে কাজের গতি বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে গোল্ডম্যানের এক কর্শী জানিয়েছেন, এছাড়া তাদের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

প্রায় একই ধরনের কথা জানিয়েছে সিটিগ্রুপ ইনকরপোরেশন ও ব্যাংক এজি। তাদের কর্মীরাও নির্বিঘ্নে বাড়িতে বসে কাজ করছেন। কাজের ব্যাঘাতের কথা চিন্তা না করে অনেক আউটসোর্সিং ইউনিট কর্মীদের সুস্থ থাকা ও চিকিত্সা সহায়তার বিষয়টিকে বড় করে দেখছে। সম্প্রতি অ্যাকসেঞ্চার পিএলসির ভার্চুয়ার করপোরেট স্ট্র্যাটেজি মিটিংয়ে আয় বাড়ানো বা পদোন্নতিক বিষয় প্রাধান্য পায়নি। বরং কর্মীদের কাজে নমনীয়তা, কাজের চাপ কমানোসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের বলে দিয়েছে যে আগামী কিছু সপ্তাহের জন্য সেবার মান কিছুটা শিথীল থাকবে। তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশাও কিছু কম রাখতে হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন