অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার

স্ট্যাগফ্লেশনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে কি?

নুরিয়েল রুবিনি

আগামী কয়েক মাসে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তা সাময়িক হবে কিনা, এটি কভিড-১৯ সৃষ্ট মন্দা থেকে উত্তরণ আদৌ ঘটাবে কিনা, কিংবা মন্দা জিইয়ে রাখবে কিনা, ডিমান্ড পুল অ্যান্ড কস্ট-পুশ ফ্যাক্টরের প্রতিফলন ঘটাবে কিনাএসব বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে।

বিশেষজ্ঞদের কিছু যুক্তিতে মূল্যস্ফীতির ব্যাপকতর উল্লম্ফনের কথা বলা হচ্ছে, যেটি এক দশকের অধিক সময় ধরে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার নিচে ছিল। এক্ষেত্রে প্রথম যুক্তি হলো, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি উদ্দীপ্ত করতে বিপুল আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে। ফলে দেশটির অর্থনীতি এরই মধ্যে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। গত বসন্তে দেশটিতে ট্রিলিয়ন ডলার প্যাকেজ, গত ডিসেম্বরে ৯০০ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা এবং গত মার্চে বাড়তি দশমিক ট্রিলিয়ন ডলার প্যাকেজ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তদুপরি শিগগিরই ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো বিলও আসবে। এভাবে করোনা সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম হবে ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে দেশটির পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের চেয়ে বড়। ফলে সংগত কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

এক্ষেত্রে একটি পাল্টা যুক্তি হলো, প্রণোদনা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি ঘটাবে না। কারণ পরিবারগুলো প্রণোদনার একটা বড় অংশ ঋণ পরিশোধের জন্য সঞ্চয় করবে। অধিকন্তু, অবকাঠামোয় বিনিয়োগ শুধু চাহিদা নয়, জোগানও বাড়াবে। মূলত এটি অর্জিত হবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকারী রাষ্ট্রীয় পুঁজির মজুদ বাড়ানোর মাধ্যমে। তবে এসব ডিনামিক্স আমলে নিলেও আর্থিক প্রণোদনা বাহিত ব্যক্তি সঞ্চয়ের প্লাবন ইঙ্গিত দেয় যে, দমিত চাহিদার ক্ষেত্রে কিছুটা মূল্যস্ফীতিমূলক স্বস্তি থাকবে।

দ্বিতীয় আরেকটি সম্পর্কিত যুক্তি হলো মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ এবং অন্যান্য বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রা ঋণ সহজীকরণসহ বিপুলভাবে সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করছে। তারা বিপুল অর্থ বাজারে প্রবাহিত করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে জোগানো এই তারল্য এরই মধ্যে স্বল্পমেয়াদে সম্পদ মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনীতি পুনরায় খুলে দেয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হওয়ায় ঋণ প্রবৃদ্ধি এবং প্রকৃত ব্যয় বাড়বে। কেউ কেউ যুক্তি দেবে যে যখন সময় আসবে, তখন স্থিতিপত্র কমিয়ে এবং নীতি হার শূন্য কিংবা ঋণাত্মক মাত্রায় এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সহজেই অতিরিক্ত তারল্য মুছে ফেলতে পারবে। তবে যুক্তি মেনে নেয়া কঠিন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিপুল আর্থিক ঘাটতি অর্থায়ন (মনিটাইজ) করে এসেছে হেলিকপ্টার মানি বা আধুনিক মুদ্রানীতি প্রয়োগের মাধ্যমে। এটি এমন এক সময়, যখন বিভিন্ন  দেশে (উন্নত দেশগুলোয় জিডিপির ৪২৫ শতাংশ এবং বৈশ্বিকভাবে জিডিপির ৩৫৬ শতাংশের উচ্চ ভিত্তিরেখা থেকে) সরকারি ব্যক্তিঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। অবস্থায় কেবল স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি সুদহারের সমন্বয় ঋণের বোঝাকে স্থায়িত্বশীল রাখতে পারে। মুহূর্তে গতানুগতিক মুদ্রানীতি গ্রহণ বন্ড ঋণবাজারকে বিপর্যস্ত করবে, মন্দা উসকে দিয়ে পুঁজিবাজারের পতন ঘটাবে। বিভিন্ন নীতি হাতিয়ার প্রয়োগে অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দেয়ায় অনেকক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে।

এখানে পাল্টা যুক্তি এই যে যখন অর্থনীতি পূর্ণ সক্ষমতা পূর্ণ কর্মসংস্থানে পৌঁছাবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা স্বাধীনতা বজায় রাখতে যা প্রয়োজন তা করবে। এক্ষেত্রে একটি বিকল্প উপায় হবে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা কমানো, যা তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করবে এবং পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ করে দেবে। 

তৃতীয় যুক্তি এই যে আর্থিক ঘাটতির অর্থায়ন (মনিটাইজেশন) মূল্যস্ফীতিমূলক হবে না; বরং এটি মূল্যসংকোচন ঠেকাবে মাত্র। অবশ্য অনুমান করা হচ্ছে যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বর্তমানে বিরাজমান অভিঘাত অনেকটা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের মতোই যখন সম্পদ বুদ্বুদ ঋণ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল, যার প্রভাবে সামষ্টিক চাহিদা হ্রাস পেয়েছিল।

আজকে সমস্যা হলো, আমরা একটি ঋণাত্মক সামষ্টিক সরবরাহ অভিঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। অবস্থায় অতিমাত্রায় শিথিল মুদ্রা আর্থিক নীতিগুলো মূল্যস্ফীতি ঘটাতে পারে কিংবা স্ট্যাগফ্লেশনের (উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মন্দা) পরিস্থিতি আরো খারাপ করতে পারে। সর্বোপরি, ১৯৭০-এর দশকের স্ট্যাগফ্লেশন এসেছিল ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ এবং ১৯৭৯ ইরানীয় বিপ্লব-পরবর্তী দুই ঋণাত্মক তেল সরবরাহের অভিঘাতের পর।

আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের কয়েকটি সম্ভাব্য ঋণাত্মক সরবরাহ অভিঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার। আর সেটি প্রয়োজন মূলত সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে হুমকি এবং উৎপাদন ব্যয় বাড়ার সম্ভাব্য ফ্যাক্টর উভয়ের কারণে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বি-বিশ্বায়ন বেড়ে চলা সংরক্ষণবাদ, মহামারী-পরবর্তী সরবরাহ ত্রুটি, চীন-আমেরিকান শীতল যুদ্ধ গভীরতর হওয়া, বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়ের আসন্ন বলকানাইজেশন, চীন থেকে নিম্ন ব্যয়ের বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ উচ্চ ব্যয়ের স্থানগুলোয় স্থানান্তরসহ কিছু বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা।

উন্নত উদীয়মান অর্থনীতিগুলোয় জনমিতিক কাঠামোও সমানভাবে উদ্বেগজনক। যখন বয়োজ্যেষ্ঠ সহচররা সঞ্চয় ভেঙে চাহিদা চাঙ্গা করছে, ঠিক তখনই অভিবাসনের ওপর নতুন বিধিনিষেধ শ্রমব্যয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব ফেলছে।

অধিকন্তু, বেড়ে চলা আয় সম্পদ অসমতার মানে হলো জনতুষ্টবাদী নেতৃত্ব চাঙ্গা হওয়ার হুমকি বজায় থাকবে। একদিকে এটি কর্মী ইউনিয়নগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে আর্থিক নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির রূপ নিতে পারে, যা শ্রমব্যয়ের একটি বাড়তি চাপের উৎস। অন্যদিকে করপোরেট খাতে গোষ্ঠীতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনও মূল্যস্ফীতিমূলক। কারণ এটি উৎপাদকদের দাম নির্ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। অবশ্যই হ্যাঁ, বড় টেক কোম্পানি এবং মূলধননিবিড়, শ্রমসাশ্রয়ী প্রযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরো বড় মাত্রায় উদ্ভাবন দক্ষতা কমাতে পারে।

স্থবিরতামূলক তত্ত্বের পাল্টামুখী বয়ানও আছে। জনপ্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং রোবটিকসে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করবে। একই সঙ্গে অবসর গ্রহণে প্রলম্বিত সময়/হাই রিটায়ারমেন্ট এইজ (বিপুল শ্রম সবরাহের ইঙ্গিত দেয়) জনমিতিক প্রভাব দারুণভাবে বদলাতে পারে।  

সমরূপভাবে, আজকের বিশ্বায়নের বিপরীত প্রবণতা নিজেই পরিবর্তন হতে পারে, যেহেতু আঞ্চলিক একীভূতকরণ বিশ্বের অনেক অংশেই গভীরতর হচ্ছে এবং যেহেতু সেবার আউটসোর্সিং শ্রম অভিবাসের প্রতিবন্ধকতার সমস্যা দূর করছে (একটি ইউএস অ্যাপ ডিজাইন করতে ভারতীয় কোনো প্রোগ্রামারকে এখন আর সিলিকন ভ্যালিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না) চূড়ান্তভাবে আয়বৈষম্যে যেকোনো হ্রাস চাহিদা চাঙা করতে পারে এবং ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতিমূলক হওয়ার পরিবর্তে তা সংকোচনমূলক সেক্যুলার স্ট্যাগনেশন ঘটাতে পারে।

স্বল্পমেয়াদে পণ্য, শ্রম ভোগ্যপণ্যের বাজার এবং কিছুটা গৃহায়ণ বাজারে শিথিলতা একটি স্থায়িত্বশীল মূল্যস্ফীতিমূলক প্লাবন প্রতিহত করবে। তবে শিথিল মুদ্রা আর্থিক নীতিগুলো আগামী কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতিমূলক, এমনকি চূড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক স্থবিরতামূলক চাপ ফেলা শুরু করবে। এটি ঘটবে মূলত ধারাবাহিক যেকোনো ঋণাত্মক অভিঘাতের উত্থানের কারণে।

কোনো ভুল করা যাবে না। মূল্যস্ফীতির রিটার্নের সাংঘাতিক অর্থনৈতিক আর্থিক পরিণাম থাকবে। আমরা গ্রেট মডারেশন থেকে সামষ্টিক অস্থিতিশীলতার এক নতুন সময়ে চলে এসেছি। বন্ডের অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখী বাজার অবশেষে নিঃশেষিত হবে এবং নামিক প্রকৃত বন্ড ইল্ডের বৃদ্ধি আজকের ঋণকে অস্থায়িত্বশীল করে তুলবে, বৈশ্বিক মূলধন বাজারে পতন ঘটাবে। এমনটি হলে আমাদের হয়তো আরো একবার ১৯৭০-এর ধরনের অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রত্যাবর্তন দেখতে হবে এবং তা হবে একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত। কাজেই স্ট্যাগফ্লেশন এড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপক এবং সর্বোপরি সরকারকে প্রয়োজনীয় সব নীতি হাতিয়ার ব্যবহার করতে হবে বৈকি।

[স্বত্ব:
প্রজেক্টসিন্ডিকেট
]

 

নুরিয়েল রুবিনি: নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন