আলোকপাত

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে গাছের প্রয়োজনীয়তা

এম আর খায়রুল উমাম

একটা গাছ। বিশ্বে ব্যক্তিগত, সমাজ, পরিবেশ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। খাদ্য, বস্ত্র, জ্বালানি, পশুখাদ্য, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষিজমির উর্বরা শক্তি রক্ষা, গৃহনির্মাণসামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, মাটির ক্ষয়রোধ, পরিবেশ শীতল রাখা, বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ, বায়ুশোধন, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার, উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিতে একটা গাছ বিশ্ব পরিবেশ অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এমন উপকারী গাছের প্রতি মানুষ সদয় নয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নির্বিচারে গাছ বনজ সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। ফলে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উষ্ণায়ন, অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত, ভূমিক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মরুকরণের প্রকোপ, ভূগর্ভস্থ পানির সংকট ইত্যাদির মতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।

আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের লাখ লাখ মানুষ শুধু তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বনজ সম্পদের ওপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল। তাদের চাষাবাদের জন্য জমি, রান্নার জন্য জ্বালানি, গৃহপালিত পশুর জন্য খাদ্য প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য আবাদের জমি প্রয়োজন। পুরনো জমির মালিকানা সমস্যায় নতুন নতুন জমি চাই। সেই জমির চাহিদা পূরণে লাখ লাখ মানুষ পতিত এবং অদাবীকৃত জমির খোঁজে বনজ এলাকা ধ্বংস করছে। কাঠের আসবাব তৈরি করতে বনজ সম্পদ ব্যবহারের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য বিদেশে এবং দেশে আসবাব তৈরিতে বনজ এলাকা ধ্বংস হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বনাঞ্চলে যাওয়া সহজ হয়ে উঠেছে। এতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বনজ সম্পদ ব্যবহারের নতুন নতুন উপায় আসছে এবং বনাঞ্চল ধ্বংস করে শুধু বাঁচার রসদ সংগ্রহ নয়, বরং অর্থকরী ব্যবসা সম্প্রসারণেও বন উজাড় করা হচ্ছে।

পৃথিবীর ওপর মানুষের কার্যকলাপের প্রভাব খুব ব্যাপক। মানুষ কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, তা খুব তাত্পর্যপূর্ণ। ফলে গত কয়েক শতকের মধ্যে পৃথিবীর অনেক জায়গা এমনভাবে বদলে গেছে যে নিজেদের আদি চেহারাটাই চেনার কোনো উপায় নেই। মানুষ কাঠ ধাতুকে কাঁচামাল হিসেবে রূপান্তর করছে, গাড়ি চালাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, কীটনাশক সার ব্যবহার করছে, পানি মাটিতে বর্জ্য ফেলার আধার করছে, পশুর চারণভূমি খাদ্য উৎপাদনে বনজঙ্গল পরিষ্কার করছে। মানুষ তার জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার জন্য উন্নয়নের লাগামহীন ধারা অব্যাহত রাখার ফলে পরিবেশের নেতিবাচক পরিবর্তন চলমান। এতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এবং আগামী প্রজন্মেরও ভবিষ্যৎ বিপন্ন হচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশের লাগামহীন পরিবর্তনের ঝুঁকি এখন আর কোনো ধারণা নয়, তা প্রমাণিত সত্য।

মানুষের জমি ব্যবহারের ধরন শিল্প উৎপাদন সামর্থ্য বিশ্ব পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পের প্রসার, জ্বালানি শক্তি ব্যয় ইত্যাদি অনুঘটক পরিবেশের রূপান্তর ঘটাচ্ছে। জাতিসংঘের অনুমান শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা এক হাজার কোটি বা তার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। ক্রমবর্ধমান জনসমষ্টির জন্য খাদ্য জোগান দেয়ার সামর্থ্য বিবেচনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতির দিকে আসতে শুরু করার আগেই জনসংখ্যা এক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। পৃথিবী অবশ্য জনগোষ্ঠীর জন্য সুষম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আহার জোগান দিতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যে অনাহারী মানুষের মিছিল দেখা যায়, তার জন্য খাদ্যাভাবের চেয়েও দায়ী খাদ্যের যথাযথ বণ্টন ব্যবস্থার অভাব। যদিও অনেকে বলে থাকেন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক পিছিয়ে বলেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব। খাদ্যাভাবই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে স্থিতির দিকে নিতে সহায়ক হবে। মানুষ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আবাদি জমি বাড়াচ্ছে, উন্নত বীজ রোপণ করছে, সেচের ব্যবস্থা করছে, কীটনাশক ব্যবহার করছে। এসব করার ফল হিসেবে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

একসময় গ্রামে সপ্তাহে মাত্র দুদিনের হাট থেকেই মানুষের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল। হাটে সাজানো থাকত সর্বোচ্চ ২০০ রকমের দ্রব্যসামগ্রী। শহরের প্রতিদিনের বাজার দোকানেও সর্বোচ্চ ৩০০ রকমের সামগ্রী পাওয়া যেত। মানুষ এই দুই-তিনশ রকমের পণ্যের মধ্য থেকেই নিজেদের প্রয়োজন সামর্থ্য বিবেচনায় ক্রয় করত। এখন যেকোনো একটা আধুনিক শপিংমলের মধ্যে থরে থরে কয়েক হাজার রকমের পণ্য সাজানো থাকে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সব দ্রব্যের প্রয়োজন আছে কিনা, তা নিশ্চিত করা কঠিন হলেও বিলাসিতার অন্তহীন ক্ষুধা সীমাহীন অপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকে চলমান রেখেছে। কিছু মানুষের অন্তহীন ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য পৃথিবীর উৎপাদনশীল জমি, উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য, পানি, বায়ু, আবহাওয়ার ওপর এসব পণ্যের উৎপাদন বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রতি হাজার বছরে কয়েক ইঞ্চি পুরু যে উর্বর মাটির সৃষ্টি হয়, তা উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে, মরুকরণ হচ্ছে, প্রতিযোগিতা করে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার চলছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বাতাসে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের আগমন ঘটছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

গত ১৮ হাজার বছরে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রবণতা বছরে ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। বর্তমানকালে মানুষের অন্তহীন বিরূপ কার্যক্রমে তৈরি গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে উষ্ণায়ন এক শতকের মধ্যে এমনই বৃদ্ধি ঘটবে। বহু শত বছরের কালপরিক্রমায় পরিবেশে এক প্রকার পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছি, যাতে পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন হারে আবহাওয়া বদলে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। বর্তমানে হিমবাহ স্থলভাগের বরফ আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে গলছে এবং বরফগলা পানিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ১৮ হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগের সময় সমুদ্রের পানির উচ্চতা এখনকার সময়ের চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ মিটার নিচু ছিল। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। এখন পর্যন্ত বিশ্বভিত্তিক গড় হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা শূন্য দশমিক থেকে দশমিক মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আবার মানুষ যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ না করে এবং ২০৫০ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যায়, তবে তাপমাত্রা থেকে ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

বাংলাদেশ একটা -দ্বীপ। ভারত, নেপাল, তিব্বত চীন থেকে নদীগুলো -দ্বীপে এসেছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জায়গা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ মিটারের কম উঁচু। ফলে বিজ্ঞানীদের অনুমান বর্তমানে উষ্ণায়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশের ১৮ শতাংশ জমি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে, যা থেকে দেশের ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহ হয়। ২১০০ সালে দেশের যে ভূখণ্ড তলিয়ে যাবে তা থেকে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫ শতাংশের জীবিকা নির্বাহ হয়। তার মানে যে জমি থেকে দেশের মোট সার্বিক উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায়, তা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে থাকবে। এলাকার মানুষ বাস্তুহীন হবে, জীবন-জীবিকার বিকল্পের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে। এরই মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ভূমিক্ষয়, মরুকরণ, চরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস ইত্যাদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিশ্ব উষ্ণায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা নগণ্য। সরকার বিশ্বাস থেকে বোধ করি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে সুন্দরবন ধ্বংসে এর ঠিক পাশেই কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে। বেহিসাবি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সবুজ বিপ্লবের নামে জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে, গোলাপি বিপ্লবের নামে লোনা পানিকে দেশের ভেতরে নিয়ে আসা হচ্ছে, আর্সেনিককে অবারিত পথ করে দিচ্ছে, রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহারে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে, নদীতে শিল্পবর্জ্য তেল ফেলে দূষণ করা হচ্ছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নদী শাসন করতে গিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করা হচ্ছে, অপরিকল্পিত সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করে নদীকে বেঁধে রাখা হচ্ছে, বসতবাড়ির জন্য প্লট নয়, ফ্ল্যাটের নীতিতে ভার্টিক্যাল সম্প্রসারণকে ব্যাহত করা হচ্ছে, পরিবহনের ক্ষেত্রে রেল নদীপথকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা উন্নয়ন করা হচ্ছে না, এমন বহু অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে ভরা দেশ আমাদের বাংলাদেশ।

বিজ্ঞানীরা বলেন, বিভিন্ন উপায়ে বায়ুমণ্ডলে আসা মোট কার্বনের প্রায় অর্ধেক সমুদ্র উদ্ভিদকুল গ্রহণ করে এবং বাকি অর্ধেক বায়ুমণ্ডলে থেকে যায়। তাই বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখতে উদ্ভিদ মানবসমাজের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনোভাবেই হোক অরণ্য, বৃক্ষ ধ্বংসের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা খুবই দরকার। কিন্তু মানবসমাজ নিষিদ্ধ কাজটাই খুব যত্নের সঙ্গে করে চলেছে। কার্বন বাণিজ্যের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী বনায়নের উদ্যোগ দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম চলমান। কালের যাত্রার ধ্বনি এখনো না শুনলে আর কবে শুনব?

 

এম আর খায়রুল উমাম: প্রাবন্ধিক

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন