করোনায় প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ

স্বল্পমেয়াদে নগদ সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন

কভিডের প্রভাবে দেশের মানুষের আয় কমেছে। কর্মহীন হয়ে অনেকে নতুন করে দারিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। সর্বসম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অক্সফাম বাংলাদেশের যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ৮৬ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছে না এবং কভিডের প্রভাবে প্রত্যেকের আয় কমেছে গড়ে ১২ শতাংশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে না পারার বিষয়টি উদ্বেগজনক বৈকি। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকারের এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ আয় বাড়ানো। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভোগনির্ভর। ভোগ বাড়লে উৎপাদন বাড়ে, বিনিয়োগ বাড়ে। ফলে ভোগ কমে গেলে অর্থনীতির গতিও স্তিমিত হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশে শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে জড়িত। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি লেগেছে খাতে। ফলে একের পর এক কর্মহীন মানুষের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে তারা। এর বাইরে আনুষ্ঠানিক খাতেও কর্মসংস্থান হারিয়েছে। অর্থনীতিকে জাগিয়ে রাখতে সরকারও বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। তবুও বেকার হওয়ার সংখ্যা বাড়ছেই। সরকারের ব্যবস্থাপনায় খাদ্যশস্য কেনা এবং প্রকৃত উপকারভোগীর হাতে পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ। এতে দুর্নীতিরও আশঙ্কা থাকে। এর বদলে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তাদের মোবাইল ব্যাংক হিসাব খুলে সেখানে সরাসরি সরকারি অর্থ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ায় নগদ অর্থ প্রদান কার্যক্রম সাফল্য লাভ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য জটিলতা হলো, কর্মহীন মানুষের গ্রহণযোগ্য তথ্যভাণ্ডারের অভাব। কর্মহীন শ্রমিকের আপত্কালে সহায়তার জন্য নেয়া হয় নগদ অর্থ প্রদানের কর্মসূচি। দুর্ভাগ্যক্রমে আলোচ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখন পর্যন্ত তহবিলের অর্থছাড়ের হার মাত্র দশমিক শতাংশ। একে গতিশীল করা প্রয়োজন। গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বরাদ্দের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিতরণ করা হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শতভাগ বয়স্ক, বিধবা প্রতিবন্ধীদের সহায়তার জন্য বরাদ্দ থাকলেও বিতরণ করা হয়েছে কম। লক্ষ করা যাচ্ছে, যেসব প্যাকেজের আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশি উপকৃত হতে পারে, সেসব প্যাকেজের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। অবস্থায় প্রণোদনা প্যাকেজের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনা মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন।

বর্তমান সংকট মোকাবেলায় জনগণের দুর্ভোগ কমানোয় প্রণোদনার কার্যকারিতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরলে সামাজিক সুরক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট প্যাকেজটি সময়মতো বাস্তবায়ন হতো। মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশের সরকার একটি নম্বর দিয়েছিল। করোনার কারণে নতুন করে যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা নিজেরাই প্রদত্ত নম্বরে যোগাযোগ করে চাকরি হারানোর কথা সরকারকে জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে সরকার চাকরি হারানোদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশও ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এদের সুরক্ষা প্রদানে নগদ অর্থসহায়তার উদ্যোগ নিতে হবে। করোনার প্রভাব প্রায় প্রতিটি খাতেই কম-বেশি পড়েছে। এক্ষেত্রে তাই প্রণোদনার বণ্টনও হওয়া উচিত ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ সক্ষমতা অনুযায়ী। যারা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সহায়তা দিতে হবে দ্রুত। গবেষণায় দেখা গেছে, নগদ অর্থসহায়তা প্রদান ব্যয়সাশ্রয়ী অধিক কার্যকর। সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে দরিদ্র ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ সহায়তা প্রদানের। এখন এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানবিহীন পুনরুদ্ধার গত এক দশকে অর্জিত আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে চরম ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, বিশেষ করে দেশে স্বাভাবিক সময়েই যখন তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উচ্চমাত্রায়। অবস্থায় কম দক্ষ মানুষের জন্য আয় তুলনামূলক কম হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে আরো কিছু খাতভিত্তিক প্রণোদনা বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সবার জন্য উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির জন্য যা অপরিহার্য। কর্মচ্যুতির বিষয়টি সামনে আরো বড় ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অবস্থায় কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য গৃহীত কর্মসূচিটিকে পশ্চিমা দেশগুলোর আদলে স্থায়ী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় রূপ দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এটা ইতিবাচক। সব পক্ষের সমন্বয়ে বিদ্যমান ত্রুটি চিহ্নিত করে একটি টেকসই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিনির্মাণ করা হবে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

মুহূর্তে জরুরি শ্রমঘন উপখাতগুলোয় বাড়তি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, যা থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ পণ্য রফতানি করতে পারে। উচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সংশ্লিষ্ট খাত হচ্ছে কৃষি, তৈরি পোশাক, চিকিৎসাসংক্রান্ত পণ্য সরঞ্জাম উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পরিবহন লজিস্টিক, খুচরা ব্যবসা, নির্মাণ, ওষুধ স্বাস্থ্যসেবা। কর্মহীনদের নতুন বিষয়ে দক্ষ করে তোলা মহামারী-পরবর্তী সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মহামারীর সময় অনেক কর্মক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অনেক কর্মী তাদের সাবেক কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারবেন না, তাদের নতুন কাজের দক্ষতা অর্জন করতে হবেই। নীতিনির্ধারক মহলকে একসঙ্গে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। শুধু প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাবে না। উদ্ভাবন উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি না দিলে ভেস্তে যেতে পারে প্রণোদনা কর্মসূচি। ডিজিটাল আর্থিক সেবা, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নেয়া, এসবের মধ্যে একটি সমন্বিত কৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি কর্মসংস্থান জীবিকার বিষয়টি সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার এরই মধ্যে বিষয়ে কাজ করছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি কৃষি, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা। কারণ যারা বেকার হয়ে গ্রামের পথে আছেন, তাদের কৃষি ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের দিকে ধাবিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষকে যুক্ত করার প্রয়াস নিতে হবে।

করোনাভাইরাসের মন্দার সময় বিশ্বের অনেক দেশ তাদের জিডিপির ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। বড় সংকটের সময় অনেক দেশকে রকম প্রণোদনা দিতে হয়। অনেক দেশে যেমন বেকারত্বের ভাতা দিতে হয়। আমাদের এখানে সে রকম ভাতা না দিতে হলেও এটার একটা সামাজিক রাজনৈতিক মূল্য আছে, সেটা সরকারকে বহন করতে হবে। সুতরাং অর্থনৈতিক দিক থেকে, চাকরির দিক থেকে, সামাজিক রাজনৈতিক দিক থেকে প্রণোদনার গুরুত্ব ব্যাপক। শুধু প্রণোদনা ঘোষণা করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। সরকার দরিদ্র কর্মচ্যুত মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রত্যেকটির বাস্তবায়নের গতি ধীর। সরকার অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার বণ্টন দ্রুত সুষ্ঠু না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সরকারি প্রণোদনার অর্থ পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষ করে জনসম্পদ তৈরিতে জোর দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন