১৯৮০ সাল। ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট তখনো পরিচালক হয়ে ওঠেননি। বয়স মাত্র ২১। দুই চোখ ভরা স্বপ্ন আর শিল্প-সাহিত্যের প্রতি প্রবল ঝোঁক একটু বেশিই সাহসী করে তুলেছে তাকে। সাহস আর স্বপ্নকে পুঁজি করে দাঁড়ালেন তখনকার জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্টিফেন কিংয়ের সামনে। একটা আবদার জানালেন। কিংয়ের ‘দ্য ওম্যান ইন দ্য রুম’
গল্প অবলম্বনে শর্টফিল্ম বানাতে চান ফ্র্যাঙ্ক। বিখ্যাত লেখক তার প্রিয় একটি গল্প অখ্যাত নির্মাতার হাতে তুলে দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কথায় আছে না, ‘ভাগ্য সাহসীদের সহায়’?
স্টিফেন কিং কয়েকদিন আগেই ভেবেছিলেন, নতুনদের সুযোগ দেবেন। কোনো তরুণ নির্মাতা এলে সহজ দুটি শর্তে তার গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি দেবেন। প্রথম শর্ত হলো গল্পের বিনিময়ে দিতে হবে ১ ডলার। দ্বিতীয় শর্ত, গল্প নির্মাণের পর কিং সেটা দেখবেন। তার মন জয় করতে পারলেই সেটি প্রদর্শনের অনুমতি দেবেন। কিংয়ের শর্ত দুটি তরুণ পরিচালকের কাছে মনে হলো সোনার হরিণ।
গল্প পেয়ে গেলেন। নিজেই লিখলেন চিত্রনাট্য। শুরু করলেন নির্মাণ। তিন বছর লেগে গেল। শর্টফিল্ম শেষ করতে পারলেন না। এর মধ্যে ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট পড়লেন আর্থিক সংকটে। সিনেমার পোস্ট প্রডাকশনের কাজ করার টাকা নেই। চাকরি নিলেন ফ্র্যাঙ্ক। প্রপ অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করে জমালেন ১১ হাজার ডলার। ৭ হাজার ডলার খরচ করলেন সিনেমার পেছনে।
শর্টফিল্ম নির্মাণের পেছনে ড্যারাবন্টের এ ত্যাগ বৃথা যায়নি। সিনেমাটি দেখে মুগ্ধ হলেন লেখক কিং। আস্থাও জন্মাল তরুণ পরিচালকের প্রতি। যেন এ সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন ড্যারাবন্ট। ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন। স্টিফেন কিংয়ের ‘রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ উপন্যাসিকাটি চেয়ে বসেলন। এবার তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। রাজি হলেন স্টিফেন। তবে বিস্মিতও হলেন। কারণ লেখকের ধারণা, এ উপন্যাসিকার গল্প আহামরি কিছু না। নেই নাটকীয়তাও। এ গল্পে চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব, এমনটাও তিনি ভাবেননি।
গল্প পেয়ে গেছেন। এবার তাকে পায় কে? নিজের সবটুকু মেধা ঢেলে দিলেন চিত্রনাট্যের কাজে। সবশেষে যা দাঁড়াল, রক এন্টারটেইনমেন্টের প্রযোজক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। স্টিফেন কিংয়ের আরেক গল্প অবলম্বনে ‘স্ট্যান্ড বাই মি’
নির্মাণ করে হইচই ফেলে দেয়া পরিচালক রব রেইনার অবাক হয়ে গেলেন। এত সুন্দর চিত্রনাট্য? কিনে নিতে চাইলেন। ৩০ লাখ ডলার দাম হাঁকালেন। ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্টের সুযোগ ছিল চিত্রনাট্যটি ৩০ লাখ ডলারে বিক্রি করে ‘দিন আনি দিন খাই’
অবস্থা থেকে রাতারাতি ধনী হয়ে যাওয়ার। হলিউডে তখন চিত্রনাট্য লিখে ৩০ লাখ ডলার আর কেউ পায় না। এত লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও দারিদ্র্যের কাছে বিক্রি করেননি স্বপ্ন। ড্যারাবন্ট সাফ জানিয়ে দিলেন, এ চিত্রনাট্য দিয়েই নির্মাণ করবেন প্রথম চলচ্চিত্র।
দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন টম ক্রুজ। কিন্তু যখন দেখলেন এক অখ্যাত পরিচালক এটা নির্মাণ করবে, রাজি হলেন না ক্রুজ। এটা ছিল সিনেমা শুরুর আগেই বড় ধাক্কা। টম ক্রুজ অভিনয় করলে সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে ভাবতে হতো না প্রযোজকদের। কি আর করা, টম ক্রুজ চাননি অখ্যাত পরিচালকের কাজ করে নিজের ইমেজ নষ্ট করতে। প্রধান চরিত্রে নেয়া হলো টিম রবিন্সকে। সঙ্গে মরগান ফ্রিম্যান।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে যায়নি। দর্শকের উপচে পড়া ভিড় ছিল না থিয়েটারগুলোতে। বরং বলা যায়, যে হলে শশাঙ্ক রিডেম্পশন চলছে, তার আশপাশ দিয়ে মাছিও ওড়ে না। কোনোমতে লগ্নি তুলে সন্তুষ্ট থাকতে হয় প্রযোজকদের। আড়াই কোটি ডলার খরচ করে বানানো সিনেমা আয় করেছিল মাত্র ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়া সিনেমাটিই ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজ (আইএমডিবি) রেটিংয়ে বছরের পর বছর ধরে এক নম্বরে অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ লাখ ভোট পেয়ে ১০-এ ৯ দশমিক ৪ রেটিং নিয়ে বিখ্যাত সিনেমা দ্য গডফাদারকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। ২০১১ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ টলাতে পারেনি দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের শীর্ষস্থান। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দ্য গডফাদার পেয়েছে ১৬ লাখ ৫২ হাজার ভোট।
১৯৪৭ সালে ব্যাংকার অ্যান্ডি ডুফ্রেন্স স্ত্রী ও স্ত্রীর প্রেমিককে হত্যার দায়ে দুবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাকে পাঠানো হয় কুখ্যাত শশাঙ্ক কারাগারে। এখানে এসে অ্যান্ডি দেখেন জীবনে অন্য সব রূপ। জেলজীবনের কদর্য আর কঠিন রূপ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে একজন সাধারণ ব্যাংকারকে। সঙ্গে যুক্ত হয় কয়েদি গ্যাংদের যৌন নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতন। কয়েকজন বন্ধুও জুটে যায় অ্যান্ডির। একসময় অ্যান্ডি অনুভব করে এরাই সম্ভবত তার জীবনের প্রকৃত বন্ধু। অ্যান্ডি পালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু শশাঙ্ক থেকে পালানো অসম্ভব। অ্যান্ডিকে পালাতে হবে নিরেট পাথুরে দেয়াল কেটে। বুদ্ধি খাটিয়ে সে জোগাড় করেছে খুব ছোট্ট একটা হাতুড়ি। যে হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ছিদ্র করতে শতবছর লেগে যাবে। এই জেলে অ্যান্ডিকে থাকতে হয় ১৯ বছর। তারপর কী হয়? এটাই ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’;
কিংবা এর বাইরেও আছে অনেক কিছু, যা আসলে লিখে শেষ করা যায় না।
চিত্রনাট্য, অভিনয় আর নির্মাণ গল্পকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সিনেমা। লক্ষ্য অর্জনে ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের অসীম পরিধির কথাও বলে।
রেটিং কিংবা বক্স অফিসের হিসাব বাদ দিলেও দর্শকের মানসিক উন্নতির জায়গায় ছবিটি পুরোপুরি সফল। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আশা, নিজের প্রতি বিশ্বাস আর প্রচেষ্টার মূল্য হাতে কলমে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হয়েছে মানবজীবনে মুক্তি বা স্বাধীনতার গুরুত্বও।
কিন্তু জীবনকে এত কিছু দেয়া সিনেমা কি বক্স অফিসে ব্যর্থ হিসেবে থেকে যাবে? জীবনের আলোর সন্ধান দেয়া সিনেমা নিজেই থেকে যাবে অন্ধকারে? তা বুঝি হওয়ার নয়। ১৯৯৫ সালে অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা সিনেমাটোগ্রাফিসহ সাত-সাতটি বিভাগে মনোনয়ন পায় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। যদিও পুরস্কার ঘোষণার দিন এর কলাকুশলীদের আসনে বসেই কাটাতে হয়। সাতটি মনোনয়ন পেয়েও খালি হাতে ফিরতে হয় সবাইকে। তবে একেবারে খালি হাতে ফেরায়নি অস্কার। অস্কারে এতগুলো মনোনয়ন পাওয়ায় থিয়েটারগুলো আবার প্রদশনীর ব্যবস্থা করে। এবার আর হল খালি থাকেনি। দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে সিনেমাটি দেখার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষ এর ক্যাসেট ভাড়া করেছিল। শশাঙ্ক রিডেম্পশনের জন্য এ অর্জনগুলোও খুব বেশি কিছু না। ১৯৯৭ সালে টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর অতীতের সব রেডর্ক ভেঙে দেয় চলচ্চিত্রটি। প্রায় প্রতিদিনই ছবিটি প্রচার হতো টিএনটি নেটওয়ার্কে। প্রতিদিন প্রচার হলেও এর টিআরপি দিন দিন বাড়তে থাকে। তখনকার দিনে একটা কৌতুক প্রচলিত ছিল ‘টিভি ছাড়লে আর কিছু পাও বা না পাও, দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন অবশ্যই দেখতে পাবে।’