উদ্বেগ বাড়াচ্ছে চালের মূল্যস্ফীতি

সরকারি মজুদ বাড়িয়ে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা হোক

দেশের মানুষের খাদ্যঝুড়ির প্রধান পণ্য চাল। অনেক দিন ধরে পণ্যটির মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী গত বছরের মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক শতাংশ। ডিসেম্বরের শেষে হার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক শতাংশে। এখনো ধারা অব্যাহত আছে। বর্তমানে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে চালসহ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বড় অবদান রাখছে বলে বিবিএসের হালনাগাদ তথ্যে উঠে এসেছে। চাল তথা খাদ্য উপখাতে মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বাজার পরিস্থিতির জন্য তা হবে ভয়াবহ। তাতে আর্থিক চাপে আরো পর্যুদস্ত হবে নিম্ন আয়ের মানুষ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কাজেই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

মহামারীর পুরোটা সময় ধরেই মূল্যস্ফীতির হানা চালের বাজারে। ফলে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে পণ্যটির দাম। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মান ধরনভেদে চালের দাম কেজিপ্রতি - টাকা বেড়েছে। মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাজারে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪৬-৫২ টাকায়। আর মাঝারি ভালো মানের সমপরিমাণ চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫ টাকায়। চালের মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। গত বছর সংঘটিত আম্পান এবং দুই দফা বন্যায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিশেষত আমন ফসল অনেকটা মার খায়। তার সঙ্গে যোগ হয় সরকারি মজুদ হ্রাস। সরকারি গুদামে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো চাল নেই। সর্বশেষ গত মাসের শেষের দিকে চালের সরকারি মজুদ নেমে আসে তিন লাখ টনের কাছাকাছি, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। তদুপরি সরকারি চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের লক্ষ্য অর্জনও ব্যাহত হয়। গত বছরের বোরো মৌসুমে কৃষক অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য অর্ধেকও পূরণ হয়নি। আবার গত আমন মৌসুমে নির্ধারিত সাড়ে আট লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের বিপরীতে চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮৩ হাজার ২০২ টন। দুই মৌসুমেই লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ধান-চাল সংগ্রহ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। মোটাদাগে উৎপাদন কম হওয়া, সরকারি মজুদ কমা এবং রাষ্ট্রীয় সংগ্রহ ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছেন; বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটি পরীক্ষিত উপায় হলো সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া। উন্নত দেশ দূরে থাক, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোও সঠিক তথ্যের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষত ভারতে উৎপাদন কত, সরকারি মজুদ কত আছে, বেসরকারি পর্যায়ে মজুদ কেমন আছে, তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়। দেশটি একটি অ্যাপ ব্যবহার করে মাঠ পর্যায়ের কৃষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে। পুরোপুরি সঠিক না হলেও এতে কাছাকাছি একটা চিত্র উঠে আসে। একই সঙ্গে চাহিদা জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা আছে কিনা তাও বোঝা যায়। ফলে সে অনুযায়ী পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া সহজতর হয়। নিয়ন্ত্রণে আসে মূল্যস্ফীতি। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে তথ্যগত বিভ্রাট বিদ্যমান। চালের সঠিক হিসাব নেই। সরকারি হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ের ফারাক বিপুল। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি পর্যায়ে চাল মজুদের যে হিসাব দেয়া হয়, তা সরকারকে খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বারবারই ভুল বার্তা দিচ্ছে। কারণ বড় মাঝারি কৃষক এবং চালের আড়তদার ফড়িয়াদের কাছে থাকা ধান-চাল তাদের হিসাবে আসে না। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ফরমে চালকল মালিক ব্যবসায়ীরা সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কিনা, তাও যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। তথ্যগত গরমিলের কারণে সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং যথাসময়ে বাজার নজরদারি করা কঠিন। এতে বাড়ে মূল্যস্ফীতি। কাজেই অন্য দেশের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে সঠিক তথ্যভিত্তির একটি টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার।

চালের বাজারে আজকের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভুল নীতি অনেকটা দায়ী। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী গত আগস্টে চাল আমদানির অনুমতি দেন। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করতে পাঁচ মাস সময় নিয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক দফায় বেড়েছে চালের দাম। বলা হচ্ছে, খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকবে তথ্যের ভিত্তিতে আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হয়েছে। সঠিক তথ্য থাকলে এমনটি হতো না। খাদ্য সম্পর্কিত সঠিক তথ্য সংগ্রহের কাজটি নিশ্চয়ই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা কাজটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেয়নি। সুতরাং চালের বাজারে মূল্যস্ফীতির দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।  

এমনিতে করোনা মহামারী মানুষের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে চলা লকডাউনে শ্রমজীবীদের আয়ের পথ অনেকটা বন্ধ। অবস্থায় বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি নিম্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় আরো কমিয়ে দিচ্ছে। এর প্রলম্বিত প্রভাব আরো বিপুল। এখন আমদানি অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ সরবরাহ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে হবে। সরকারি রুটিন সংগ্রহ কার্যক্রম বারবারই ব্যর্থ হয়। এবার এর ব্যত্যয় ঘটাতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার অসংগতি দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। দেশে ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ফলে পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও দাম বেড়ে যায়। তাই বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সিন্ডিকেটের কারসাজির দিকেও কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। বাজারে চালাতে হবে নিয়মিত অভিযান। সর্বোপরি বাড়াতে হবে টিসিবির তত্পরতা। সরকার এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ট্রাক সেলের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ। চালের দাম কমাতে বড় শহর থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি। বহুমাত্রিক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে চালের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবেএটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন