‘ক্যাসেট ছিল শিল্পী, শ্রোতা, গীতিকার সুরকারদের আবেগের উৎস’

তার গাওয়া অনেক গান মানুষের মুখে মুখে, কনকচাঁপা নামেই যার পরিচিতি। তিনি রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা বাংলা চলচ্চিত্রের বহু জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের কানে বাজে তার কণ্ঠে। একক যৌথ মিলিয়ে ৫০টির বেশি অ্যালবাম রয়েছে তার। সংগীতাঙ্গনের অবদানস্বরূপ তিনবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আরো অসংখ্য সম্মাননা স্বীকৃতি রয়েছে শিল্পীর অর্জনের তালিকায়। সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেছেন গান তার নানা ভাবনার কথা। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ  

কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, খুবই ভালো আছি। করোনা এখনো আমাকে ছোঁয়নি। আমি মনে করি এটা অনেক বড় সৌভাগ্য। সারা বিশ্ব যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে নিরাপদ সুস্থ থাকাটা অনেক বড় সৌভাগ্য।

মহামারীর কারণে স্বাভাবিক পেশাগত জীবনকে মিস করছেন কি?

অবশ্যই। গত বছর যখন করোনা শুরু হলো, তখন আমার শিডিউলে অনেকগুলো মঞ্চানুষ্ঠান ছিল। ছিল আমেরিকা ইউরোপজুড়ে ১১টা অনুষ্ঠানের শিডিউল। সব বাতিল হয়েছে। এগুলোকে খুব মিস করছি। তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই ভেবে, সারা পৃথিবীই তো থমকে আছে। হয়তো আমার কাজগুলো বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আমার রিজিক তো আর আল্লাহ বন্ধ করেননি। অনেকেই তিনবেলা খেতে পারছে না। সেদিক দিয়ে ভালো আছি।

এই যে বললেন, অনেকে তিনবেলা খেতে পারছে না। এমন অসহায় মানুষের জন্য কিছু করেছেন বা করার পরিকল্পনা আছে?

অবশ্যই করেছি। আল্লাহ আমাকে যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন, তার সবটা দিয়েই চেষ্টা করছি। আমার বন্ধু, প্রিয়জনদের নিয়েও অনেক কাজ করেছি। সেসব এখন বলতে চাই না। আমি আমার সাধ্যমতো ঘরে থেকে চেষ্টা করছি, চেষ্টা করে যাব ইনশা আল্লাহ।

গত এক বছরে করোনা এবং আরো নানা কারণে আমরা শিল্প-সাহিত্যজগতের অনেক গুণী মানুষকে হারিয়েছি। বিষয়টি আপনাকে কেমন ভাবায়?

প্রথমত, সবকিছু পৃথিবীর নিয়মে চলে, এটা মানতে হবে। তার পরও কিছু বিষয় মানা খুব কষ্টের। এই যেমন বাচ্চু ভাই, সুবীরদা, শাহনাজ আপা, কিশোরদা, বুলবুল ভাই, আলাউদ্দিন আলী, শাম্মি আখতার, মিতা হক, ইন্দ্রমোহন রাজবংশীওনাদের আমরা হারিয়েছি। এটা খুবই কষ্টের। দুঃখ বহন করার সাধ্য আমার নেই। আমাদের শিল্পাঙ্গনের শোকের যে পুঁতির মালা, সেই মালাটা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা অসম্ভব। আমাদের আসলে নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা। তার পরও সময় ক্ষতে মলম লাগিয়ে দেয়। সময় ধৈর্য বাড়িয়ে দেয়। সেই ধৈর্য বাড়িয়েই বেঁচে আছি।

আপনি যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, সেই সহশিল্পীদের চলে যাওয়ার শোক নিশ্চয় বেদনার্ত করে?

ওনাদের চলে যাওয়ায় আমার শোকটা কোন পর্যায়ের বলে বোঝাতে পারব না। শিল্পী মারা গেলে শ্রোতারা খুঁজে খুঁজে সেই শিল্পীর গান শোনে। আমার বেলায় হয় উল্টোটা, সুবীরদার কোনো গান শুনতে পারি না। সুবীরদা আমার এত কাছের ছিলেন, তার সঙ্গে এত বেশি কাজ করেছিসব স্মৃতি চোখে ভাসছিল। কিশোরদার চলে যাওয়ার সময়ও এমন হয়েছে। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তার কথাবার্তা, চালচলন আমার চোখে ভাসতে শুরু করে। তার আনন্দ, উল্লাস, উপদেশ সবকিছু আমার এত চেনা, যেমনটা আমার বড় ভাইকে চিনি, বাবাকে চিনি।

এবার একটু গানের প্রসঙ্গে আসি। ঈদ চলে আসছে। আগে ঈদ ঘিরে সংগীতজগতে কী ধরনের প্রস্তুতি চোখে পড়ত?

আশি-নব্বইয়ের দশকজুড়ে এমনকি শূন্য দশকেও যে ঈদ আমরা কাটিয়েছি তার কোনো অনুভূতিই এখন অবশিষ্ট নেই। তখন একটা সুখের দিন ছিল বটে। তখন নির্মল আনন্দ উপভোগের উপলক্ষ ছিল সংগীতজগত। ঈদে প্রায় সব শিল্পীর একক অ্যালবাম বের হতো। যৌথ অ্যালবাম বের হতো। গ্রামের বাজারে ক্যাসেটের দোকানে অ্যালবাম শিল্পীর নাম দিয়ে লিস্ট টাঙিয়ে রাখত। মেয়েদের যেমন ঈদে বায়না থাকত মেহেদি-চুড়ির, ছেলেদের জামা-জুতোর। শ্রোতারাও তেমনি ঈদ খরচের টাকা থেকে ক্যাসেট কেনার টাকা বাঁচিয়ে রাখত। ঈদ তো দু-তিন দিনে শেষ। কিন্তু ক্যাসেটগুলো এক-দেড় মাস ধরে বাজত গ্রামে, মহল্লায়, শহরে। কোনোটা টিকে যেত বছরের পর বছর। ঈদ ঘিরে সংগীতাঙ্গনের ব্যস্ততা বহু পুরনো। হিজ মাস্টার ভয়েস, কলরেডি সে সময় থেকেই ঈদ কিংবা পূজায় নতুন অ্যালবাম আনত। আমরা ছোটবেলায় মান্না দে, শ্যামল মিত্র, লতা মঙ্গেশকরদের অ্যালবামের জন্য অপেক্ষা করতাম। খুব সুন্দর একটা সময় ছিল। কে যাস রে, তাল পাতার বাঁশিসহ আমার বেশ কয়েকটি সুপারহিট অ্যালবাম ঈদ উপলক্ষেই বের হয়েছিল।

এখন ঈদ ঘিরে কেমন প্রস্তুতি দেখেন?

আমি একটা কথা বিশ্বাস করিযতই বুদ্ধি বাড়ে, ততই লক্ষ্মী ছাড়ে। আমাদের বুদ্ধি বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছে। ক্যাসেট প্লেয়ার চলে গেল। সিডি প্লেয়ার চলে গেল। এখন এসেছে ইউটিউব। এখন মনে হচ্ছে আমাদের লক্ষ্মী ছেড়ে গেছে। ক্যাসেট-সিডির একটা অবয়ব থাকত। ক্যাসেটের গায়ে গান লেখা থাকত। সুরকার, গীতিকারের নাম লেখা থাকত। সব মিলিয়ে একটা ক্যাসেট হতো শিল্পী, শ্রোতা, গীতিকার, সুরকারদের আবেগের উৎস। আলাদা এক অনুভূতি। এখন কি সেই অনুভূতিটা পাওয়া যায়? আমরা সেই দিনগুলো হারিয়ে ফেলেছি। এখন এগুলো শুধুই স্বপ্ন।

আগেকার দিনের সিনেমার গানের আলাদা একটা জায়গা ছিল। সিনেমার গানের ক্যাসেট বের হতো। রেডিওতে সিনেমার গানের অনুষ্ঠানগুলো সুপারহিট ছিল। সেসব গান শ্রোতারা তখন শুনেছে, এখনো শোনে। বর্তমানে সিনেমার কোনো গান স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। সংকটের কারণ কি?

আমি বলব সহজলভ্যতা। চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হলে যা হয়। গান এখন খুব সহজ, একঘেয়েমি মৌলিকতা বিবর্জিত হয়ে পড়ছে। প্রায় সব গান, সব সুর, সব কম্পোজিশন এক হয়ে গেছে। হয়তো আমরা খুব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। তবু আমি আশাবাদী, সুদিন ফিরবে অবশ্যই।

কাদের হাত ধরে সুদিন ফিরবে বলে মনে হয়?

হাবিব ওয়াহিদ ভালো কিছু কাজ করেছে। হূদয় খানও ভালো কাজ করেছে। এদের কাজ দিয়ে অনেকগুলো বছর পার করা গেছে। তারপর কী যেন হয়ে গেল। আমাদের সিনেমার গানগুলো পাশের একটা দেশ থেকে আনা শুরু হলো। তাদের ঝুড়িতে স্যাড গান আছে, রোমান্টিক, কমেডি সব গান রেডি আছে। ঝুড়িতে করে ফেরিওয়ালা যেন গান বেচছে। আপনার যা লাগবে নিয়ে আসবেন। এভাবে তো সিনেমার গান হয় না। অথচ আমরা দেখেছি একটা গানের জন্য আমাদের আলী ভাই, আলম ভাই, বুলবুল ভাই, গাজী ভাই, রফিক ভাই কত পরিশ্রম করেছেন। গবেষণা করেছেন। মিউজিশিয়ানের সঙ্গে বসেছেন। আমি আশাবাদী ইমন চৌধুরীর প্রতি। সে ভালো মিউজিশিয়ান, সুরকার, ভালো ইনস্ট্রুমেন্ট বাজায়। তার কাজ আলাদা করা যায়। শওকত আলী ইমন, ইমন সাহাদের মতো ইমন চৌধুরীর কাছ থেকেও অনেক ভালো কাজ আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

ইউটিউব, ফেসবুকসহ ভিডিও শেয়ারিংয়ের অনেক ডিজিটাল প্লাটফর্ম এসেছে। তরুণদের পাশাপাশি অভিজ্ঞদেরও ডিজিটাল প্লাটফর্মে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে?

আমি এসব মাধ্যম নিয়ে একদমই ভাবি না। আমার খুব একটা আগ্রহ জন্মে না এসবে কাজ করার। তবে ইউটিউবে হিট হওয়াকে আমি অবশ্যই মূল্যায়ন করি। কারণ হিট হওয়া অনেক কঠিন। কোটি মানুষের পছন্দ হলে বুঝতে হবে অবশ্যই গানের ভেতর কিছু আছে। সমস্যা হলো এখন অনেক মানহীন, রুচিহীন গানও হিট হচ্ছে। তার পরও দর্শক-শ্রোতার ওপর আমার আস্থা আছে। তারা শোনে সবকিছু, কিন্তু গ্রহণ করে বেছে বেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন