বছরটা শুরু করেছিলেন নায়কোচিত ভাবমূর্তি নিয়ে। শুধু ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। তবে বছরের অর্ধেক পেরুনোর আগেই বিপরীত দৃশ্যটাও দেখে ফেলেছেন আদর পুনাওয়ালা। ভারতসহ অনেক স্থানেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সরবরাহ সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে তাকে। যদিও পুনাওয়ালার দাবি, এজন্য তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট মোটেও দায়ী নয়। বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ভারত সরকারের নীতিগত ভুলের কারণেই।
বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। চলমান করোনা মহামারী থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ওপর অনেকটাই নির্ভর করেছিল ভারতসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কয়েকটি দেশের টিকাদান কর্মসূচির ভিত্তিই হয়ে উঠেছিল সেরামের সরবরাহ প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বর্তমানে ভারতের বাইরে কোথাও টিকা সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি ভারতেও প্রয়োজনমাফিক টিকা সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অন্যদিকে ভারত বর্তমানে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র।
এ অবস্থায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেরাম ইনস্টিটিউটকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে অনেক। সমালোচিত হচ্ছেন আদর পুনাওয়ালাও। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী পুনাওয়ালা বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানকার স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি দাবি করেন, টিকার সরবরাহ সংকটের জন্য এখন সেরাম ও তাকে দায়ী করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বলা হচ্ছে, সেরাম এখন টিকার সরবরাহ আটকে রেখেছে। এমনকি তাকে এ নিয়ে রাজনীতিবিদ ও সমালোচকদের কাছ থেকে অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে।
বর্তমান এ সংকটের পেছনে সেরাম বা তার নিজের কোনো হাত নেই দাবি করে পুনাওয়ালা বলেন, সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা যখন কমে আসছিল, তখনো কর্তৃপক্ষ ভাবতেই পারেনি ভারতে মহামারী প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হবে। সবাই ভাবছিল ভারত মহামারীর গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই অন্যায় ও ভুল বক্তব্যের শিকার হয়েছি।’
এফটিকে দেয়া ওই সাক্ষাত্কারে পুনাওয়ালার ভাষ্য ছিল, সেরাম ইনস্টিটিউট তার টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায়নি, কারণ ভারত সরকার শুরুতে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকা সরবরাহের ক্রয়াদেশও দেয়নি। তিনি বলেন, এ অবস্থায় আমাদেরও মনে হয়নি, আমাদের বছরে ১০০ কোটি ডোজের বেশি টিকা উৎপাদন করতে হবে।
গত ১০ দিন ধরে ভারতে করোনার দৈনিক সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তিন লাখের বেশি। এর মধ্যে একদিন তা চার লাখও অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের টিকাদান কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায় চালু রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের টিকাদান সম্পন্নের লক্ষ্য রয়েছে নয়াদিল্লির। কিন্তু বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার জানিয়েছে, স্থানীয়দের দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টিকা তাদের হাতে নেই। কোনো কোনো রাজ্যে টিকার অভাবে এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে।
এর আগে চলতি সপ্তাহেই ব্রিটিশ আরেকটি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাত্কার দেন পুনাওয়ালা। সেখানে তিনি দাবি করেন, টিকা নিয়ে ক্রমাগত হুমকির কারণে নিরাপত্তা শঙ্কায় তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। যদিও গত সপ্তাহ থেকেই পুনাওয়ালাকে উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা সুবিধা দিচ্ছে ভারত সরকার।
সাক্ষাত্কারে হুমকিগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলোকে হুমকি বললেও কম বলা হয়। এসব বক্তব্যে যে মাত্রায় প্রত্যাশা ও আগ্রাসন প্রকাশ পেয়েছে, তা সত্যিকার অর্থেই ভাবনার অতীত। সবাই মনে করছে তার টিকা পাওয়া উচিত। কিন্তু কেউ এটা বুঝতে পারছে না, কেন তার আগে অন্য কারো পাওয়া উচিত। তারা বলছে, টিকা না দিলে ভালো হবে না। এমন নয় যে তাদের বলার ভাষাটা খারাপ। খারাপ লাগে তাদের বলার ভঙ্গিমায়। এ থেকেই বোঝা যায়, যদি আমি তাদের দাবিমতো টিকা না দিতে পারি, তাহলে তারা কী করতে পারে।
ওই সময় তিনি আরো বলেন, আমি যুক্তরাজ্যে আরো কিছু সময় থেকে যেতে চাই। কারণ আমি এ পরিস্থিতিতে ফিরতে চাচ্ছি না। সবকিছু এখন আমার ঘাড়ে। কিন্তু আমার পক্ষে তা একা করা সম্ভব না।
তবে এ সাক্ষাত্কার প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরেই বিপরীত বক্তব্য দিয়েছেন পুনাওয়ালা। এক টুইট বার্তায় পুনাওয়ালা জানান, তিনি কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে ফিরছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আমাদের অংশীদারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে খুবই চমত্কার একটি বৈঠক হয়েছে। আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি পুনেতে এখন পূর্ণ মাত্রায় কোভিশিল্ডের উৎপাদন চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে কার্যক্রম তদারকির অপেক্ষায় আছি।
অন্যদিকে এফটিকে দেয়া সাক্ষাত্কারে পুনাওয়ালা বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ নয়, তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন সাধারণ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। এবং আগামী সপ্তাহেই তিনি ভারতে ফিরছেন।
ব্যবসায়িক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে সেরামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মার্চে টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ভাষ্যমতে, বেশ কয়েকটি ধনী দেশের নেতারা উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি টিকা সরবরাহের ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন। ফলে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে উল্টো। নরেন্দ্র মোদির সরকার টিকা সরবরাহের ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে খুবই ধীরগতিতে এবং প্রথম ক্রয়াদেশ দিয়েছে টিকার অনুমোদন দেয়ার পর। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়াতে গিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যাতে ভুগতে হচ্ছে অন্যদেরও। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পৃষ্ঠপোষকতায় কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিও এখন এ নিয়ে বিপাকে। এ ফ্যাসিলিটিও টিকার জন্য সেরামের ওপরই নির্ভর করেছিল। কিন্তু এখানেও টিকা সরবরাহ বন্ধ রেখেছে সেরাম। ফলে বিপদে পড়েছে কোভ্যাক্সের ওপর নির্ভর করা স্বল্প আয়ের দেশগুলো। অন্যদিকে যেসব দেশ টিকার জন্য আগাম অর্থ পরিশোধ করে রেখেছিল, টিকা পাচ্ছে না তারাও।
পুনাওয়ালার দাবি, যেসব দেশের সরকার আগাম ক্রয়াদেশ দিয়েছিল, তাদের অর্থ ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট। তবে কোন কোন দেশকে ক্রয়াদেশের অর্থ ফেরত দেয়া হচ্ছে, সেসব দেশের নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
তিনি বলেন, যদি কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন না আসে তাহলে আমি মনে করি আরো দুই-তিন মাস আমাদের কিছুটা সমস্যার মধ্যে পার করতে হবে।
এর আগে করোনার টিকার মূল্য নিয়েও সমালোচিত হয়েছেন আদর পুনাওয়ালা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতি ডোজ টিকা সরবরাহ করছেন ১৫০ রুপি মূল্যে। অন্যদিকে রাজ্য সরকারগুলোর কাছ থেকে এ বাবদ রাখা হচ্ছিল ৪০০ রুপি করে। হাসপাতালগুলোর কাছে বিক্রি করছিলেন ১ হাজার ২০০ রুপি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রাজ্য সরকার ও হাসপাতালগুলোয় সরবরাহকৃত টিকার দাম প্রতি ডোজ ৩০০ রুপিতে নিয়ে আসেন তিনি। সে সময় মুনাফা কমিয়ে রাখার বিষয়টিকে নিজের ‘ঔদার্যের অভিব্যক্তি’ বলে দাবি করে আরেক দফা সমালোচনার শিকার হন পুনাওয়ালা।