সময়ের ভাবনা

জাকাতের সুফল পেতে চাই সুব্যবস্থাপনা

তানিম আসজাদ

[গতকালের পর]

কৃষিজাত পণ্য গবাদি পশুর ওপরও জাকাত প্রদেয়। কৃষিজমিতে উৎপাদিত শস্য ফল যা ভোগ না করে সংরক্ষণ করা হয় পরবর্তী সময়ে বাজারে বিক্রির জন্য, সেগুলোর ওপর জাকাত দিতে হয়। যদি বৃষ্টি নদীনালার পানির প্রাকৃতিক ব্যবহারের মাধ্যমে শস্য উৎপাদিত হয়, তাহলে মোট উৎপাদিত ফসলের ১০ শতাংশ জাকাত হিসেবে প্রদেয়, যা উশর হিসেবে অভিহিত। আর যদি সেচের পানি দিয়ে উৎপাদিত হয়, তাহলে এই হার শতাংশ। তবে এগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত হতে হবে বা যেটুকু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হবে, সেটুকুর ওপর জাকাত হিসাব করতে হবে। আবার গবাদি পশুর ওপর জাকাত দিতে হয় যদি সেগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছায় (যেমন: ৪০টির কম ভেড়া বা ছাগল থাকলে এগুলোর ওপর জাকাত প্রযোজ্য নয়), যদি সেগুলো লালন-পালন করে দুধ দোহানো হয় সেগুলো থেকে নতুন পশু জন্ম হয়। চাষাবাদে মালটানায় ব্যবহূত উট বা গরুর ওপর জাকাত প্রযোজ্য নয়।

অবশ্যই জাকাত কতটুকু, কবে, কোথায় কাকে দেয়া হলো তা লিখে রাখতে হবে, যেন হিসাবে গোলমাল না হয়। এটা জাকাতদাতার নিজের কাছে স্বচ্ছতা আত্মিক পরিতৃপ্তির জন্য জরুরি। আবার জাকাত ঢোল পিটিয়ে দেয়ার বিষয় নয়, বরং নীরবে আদায় করাই উত্তম। খুচরো-খাচরাভাবে ৫০ জনকে না দিয়ে একটু মোটা অংক পরিকল্পিতভাবে পাঁচজনকে জাকাত হিসেবে দিতে পারলে ভালো হয়।

সংগঠন ব্যবস্থাপনা: বর্তমানে নিসাব জাকাত হিসাব করার জন্য একাধিক জাকাত ক্যালকুলেটর রয়েছে। বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান যারা জাকাত সংগ্রহ বিতরণ করে থাকে, তাদের ওয়েবসাইটে ক্যালকুলেটর দেয়া আছে। যেমন আহসানিয়া মিশন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত আদায়ের একটা ইতিবাচক দিক হলো, এরা সাংগঠিনকভাবে জাকাতের অর্থ বিতরণ করে এবং অনেক নিঃস্ব অভাবী মানুষ উপকৃত হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও সরকারি জাকাত তহবিলে জাকাত প্রদান করা যায়। ব্যক্তির পক্ষে সবসময় কাঙ্ক্ষিত বা কাম্য গন্তব্যে জাকাতের অর্থ ঠিকমতো পৌঁছানো অনেক সময় কঠিন হয়। তবে বহু ব্যক্তির জাকাতের অর্থ নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অভাবী মানুষের জীবিকার বা দুঃস্থ মানুষের সুচিকিৎসার সুব্যবস্থা করে দিতে পারে। তাতে করে এদের অনেকেই পরের বছর বা দুচার বছরের মধ্যে আর জাকাত গ্রহণের অবস্থায় থাকে না। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত দিলে অনেক ক্ষেত্রে আয়কর রেয়াত পাওয়া যায়।

জাকাতের যথাযথ বণ্টনের যে সমস্যা, তাকে অর্থনীতির সার্চ ফ্রিকশন তত্ত্বের আলোকেও দেখা যেতে পারে। ২০১০ সালে তত্ত্বের জন্য অর্থনীতিবিদ পিটার ডায়মন্ড, ডেল মরটেনসেন ক্রিস্টোফার পিসসারাইডিস অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তত্ত্বের মূলকথা হলো বাস্তব জগতে নানা ধরনের অসম্পন্নতা দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে, যার ফলে ক্রেতা বিক্রেতারা ঠিকমতো পরস্পরকে মেলাতে পারে না। বাজারে অপর্যাপ্ত তথ্য, শ্লথগতি সমন্বয়ের ঘাটতি পরিস্থিতির তৈরি করে। যেমন শ্রমিকরা কাজ খুঁজে পায় না, আবার নিয়োগদাতাও সময়মতো শ্রমিক খুঁজে পায় না। উভয়কেই কাজ কাজের লোক খুঁজতে বাড়তি সময় শ্রম দিতে হয়, যা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। তার মানে, বাজারে একই সঙ্গে বেকার কাজের সুযোগ বিরাজ করে। একইভাবে জাকাতদাতা জাকাতগ্রহীতার মধ্যে তথ্যের অভাবে প্রয়োজনীয় জাকাত প্রয়োজনমতো জাকাতগ্রহীতার কাছে পৌঁছে না। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সামষ্টিক উদ্যোগ বা সংঘবদ্ধভাবে জাকাত আদায়ের প্রয়াস কার্যকর হতে পারে।

বস্তুত জাকাতের সবচেয়ে বড় সুফল হলো সেটাই, যখন জাকাতগ্রহীতা আর জাকাতের মুখাপেক্ষী থাকে না। সেজন্যই এমনভাবে জাকাত আদায়ে উৎসাহিত করা হয়েছে যেন একসময়ের জাকাতগ্রহীতা একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজেই জাকাতদাতা হতে পারেন। জাকাতের সুফল পেতে হলে তা দৃশ্যমান করতে হলে জাকাতের সুব্যবস্থাপনা খুব জরুরি। বাংলাদেশে জাকাতের ব্যবস্থাপনা এখনো যথেষ্ট ভালো নয় বলে প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ জাকাত হিসেবে আদায় করা হয়, কোন কোন খাতে জাকাতের অর্থ ব্যবহূত হয়, কতজন মানুষ জাকাত পায় এবং কতজন জাকাতের মাধ্যমে দুরবস্থা থেকে বের হয়ে আসে, সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সংগঠন তাদের জাকাত কার্যক্রম সম্পর্কে পৃথকভাবে তথ্য দিয়ে থাকে। তবে সেগুলোকে একত্র করে মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা আজও সম্ভব হয়নি। এদিকে নজর দেয়া এখন জরুরি।

সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী গবেষক মাবরুর মাহমুদ বাংলাদেশ জাকাত মডেল নামে জাকাত ব্যবস্থাপনার একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছেন, যা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। -সংক্রান্ত ধারণাপত্রে তিনি দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশে কার্যকরভাবে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি বাধা কাজ করে। এগুলো হলো: আস্থার অভাব, নেটওয়ার্ক বা যোগসূত্রের ঘাটতি এবং পেশাদারিত্বের ঘাটতি। তিনি এসব বাধা কাটিয়ে উঠে জাকাত আদায়কে গতিশীল অর্থবহ করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় একটি অনলাইন প্লাটফর্ম বা পাটাতন খোলার প্রস্তাব রেখেছেন। এর মাধ্যমে একদিকে জাকাতের তহবিল সংগ্রহ, অন্যদিকে সংগৃহীত জাকাত সুষ্ঠুভাবে বিতরণের রূপরেখা এঁকেছেন। এজন্য তিনি তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কথা বলেছেন, প্রতিটি জাকাতের অনুদানের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বতন্ত্র ট্র্যাকিং নম্বরের পরামর্শ দিয়েছেন। ধারণাপত্রে তিনি আরো হিসাব করে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশে বছরে অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার জাকাত আদায় হতে পারে, যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অংক। এটি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ শতাংশ এবং ২০২৯-২০ অর্থবছরের বাজারমূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রায় দশমিক ১০ শতাংশ।

শেষ কথা: নিবন্ধে আমরা শুধু জাকাত আদায়ের মূলনীতি হিসাবপদ্ধতি এবং বাংলাদেশে জাকাত ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করে জাকাত সম্পর্কে প্রচলিত কিছু বিভ্রান্তিকর অস্বচ্ছ ধারণা দূরীকরণের চেষ্টা করেছি। জাকাতযোগ্য সম্পদের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। তবে আমাদের দেশের আলেম-ওলামারা জাকাত প্রদানের বিধিবিধান খাতগুলো নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি করেন, টেলিভিশনে ইউটিউবে আলোচনা করেন। এগুলো পড়লে শুনলে যথেষ্ট পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায় অনেক বিভ্রান্তি কেটে যায়। দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান জাকাত নিয়ে কাজ করে, তাদের কাছ থেকে জাকাতের খাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।

বস্তুত সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদের দান করতে উৎসাহিত করেছেন নির্দেশ দিয়েছেন যা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। দান দুই ধরনের: একটি স্বেচ্ছামূলক যাকে সদকা বলা হয়। আরেকটি বাধ্যতামূলক যা হলো জাকাত। সুতরাং, জাকাত দেয়া বা আদায় করা কোনো খামখেয়ালি বা ইচ্ছের বিষয় নয়। বরং কুরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশনার আলোকে আলেম-ওলামা-বিশেষজ্ঞরা জাকাত আদায়ের মোটামুটি অভিন্ন একটি রূপরেখা তৈরি করেছেন, যা অনুসরণ করলে সঠিকভাবে জাকাত আদায় করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। বর্তমানে কভিড মহামারীর সময়ে দেশে লাখ লাখ মানুষ যখন নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়েছে, কয়েক কোটি মানুষ নতুনভাবে গরিবির মধ্যে পড়েছে বা অভাবী হয়ে গেছে, তখন জাকাতের সুষ্ঠু দক্ষ ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেয়া খুবই প্রয়োজন। [শেষ]

 তানিম আসজাদ: লেখক সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন