লিতানি নদীর মরা মাছ ও বুড়িগঙ্গার দূষণ

আল আমিন হুসাইন

লিতানি নদী। পশ্চিম এশিয়ার দেশ লেবাননেন বৃহত্তর নদী এটি। ১৪০ কিলোমিটারেরও দীর্ঘ এ নদীকে দেশটির অন্যতম শক্তি হিসেবে ভাবা হয়। ধরা হয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবেও। কারণ বিদ্যুত্ উত্পাদন, সেচসহ অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে এটি। তবে কত কয়েক বছর ধরেই নদীটির দূষণ তীব্র থেকে তীব্রতার হচ্ছে। শিল্প-কলকারখানার বর্জ্যে এ নদীর পানি এখন বিষাক্ত। দূষণরোধে নানাবিধ পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু নদীর দূষণ রোধ করা যায়নি। দূষণের কারণে বিভিন্ন সময়ে নদী তীরবর্তী অনেক শিল্পকারখানা বন্ধও করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত সেটি নদীর প্রাণ-প্রকৃতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়নি। শিল্পবর্জ্য, পয়োবর্জ্যের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে এটি। যে নদীটি এক সময়ে মাছের অন্যতম উত্স ছিল, দূষণের কারণেই সেটিতেই ২০১৮ সালে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সে দেশের সরকার। আর দূষণের জেরে এ নদীকে কেন্দ্র করে তৈরি করা কারাউন হ্রদে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়। এ হ্রদে প্রায় ৪০ টনের মতো মাছ মরে ভেসে উঠে। যেটিকে নজিরবিহিন বলছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কর্তৃপক্ষ বলছে, দূষণের কারণে এসব মাছ মারা গেছে। পাওয়া গেছে ভাইরাসের উপস্থিতিও।

লিতানিকে আমরা নদী দূষণ ও তার বিপর্যয়কর ফলাফলের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। বৃহত্তর অর্থে এ লেখার মূল বিষয়ও তাই দেশের নদী দূষণ ও প্রাণ-প্রকৃতির ওপর মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নদীর অবদান অনেক। যুগে যুগে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ লাভ করেছে। গড়ে উঠেছে শিল্প-কলকারখানা। দেশের অর্থনীতিও নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তবে শিল্প-কারখানার উত্পাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর দূষণ ও দখলও বেড়েছে। ফলে শিল্পে প্রাণ-সঞ্চারে নদীর অবদান ভুলে যাচ্ছে মানুষ। নদীকে শিল্প বর্জ্যের ডাম্পিং স্টেশনে রূপ দেয়া হয়েছে। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য আর প্রাণ-প্রকৃতি। যদিও বাংলাদেশে নদীর দখল-দূষণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। বিস্তর গবেষণাও হয়েছে। নেয়া হয়েছে প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক ব্যবস্থাও। কিন্তু কার্যত নদী দূষণরোধ করা সম্ভব হয়নি।

দেশে নদী দূষণের এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী। এ নদী দুটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম। নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে শিল্প-কলকারখানা। শিল্প অবকাঠামো উন্নয়নে আমরা যতটা পুলকিত হই, কিন্তু এর ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, সেটি নিয়ন্ত্রণে আমরা ততটাই যেন উদাসীন। কারণ এসব শিল্প-কারখানা থেকে কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই বা নামমাত্র পরিশোধনকৃত শিল্পের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীতে। এছাড়া রাজধানীর গৃহস্থালি বর্জ্যেরও গন্তব্য বুড়িগঙ্গা। ফলে রীতিমতো বুড়িগঙ্গা এখন যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

 

অথচ এক সময় বুড়িগঙ্গার ছিল ভরা জৌলুস। মাছসহ জলজ প্রাণীর বসবাস ছিল। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার জন্য এক সময়ে অনেকেই বুড়িগঙ্গার তীরে যেত। আড্ডা দিত। কিন্তু সবার চোখের সামনে অনাদর, অবহেলায় বুড়িগঙ্গা তার সেই উচ্ছ্বলতা হারিয়েছে। নদীতে জলজ প্রাণী কমে গেছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে এখন নাক বন্ধ করে চলাচলও যেন কঠিন হয়ে উঠছে। নদীর তলদেশে পলির পরিবর্তে জমেছে শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য। নদীর প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে এসব বর্জ্য আবার পৌঁছে যাচ্ছে ছোট-বড় নদ-নদী ও খালে।

নদী দূষণ নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ঢাকার হাজারীবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার নদী রক্ষা বাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রায় সাত হাজার কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বুড়িগঙ্গা থেকে এসব শিল্পবর্জ্য গিয়ে মিশছে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে। সেখান থেকে তা আবার বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে আশপাশের অন্যান্য নদীতে।

এভাবেই দূষিত হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীও। আর এ দূষণ বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী হালদা, বাকখালী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, নাফ, কাসালং ও চিংড়ি নদ-নদীতে। কর্ণফুলীর দূষণ ছড়িয়েছে বঙ্গোপসাগরেও। করতোয়া, তিস্তা, আত্রাই, পদ্মাসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান-অপ্রধান নদ-নদীগুলোর স্বাস্থ্যও খুব একটা ভালো নয়। নানা মাত্রার দূষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি এসব নদীর কোনোটিই।

 

সামপ্রতিক একটি গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। এর মধ্যে পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বড় নদীগুলো থেকে দেশের প্রায় সব নদীতেই বিভিন্ন মাত্রায় দূষণ পৌঁছে গিয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের শিল্পের প্রায় ৬০ হাজার টন বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়। সেখান থেকে তা বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে।

 

ক্ষতিকর ভারী ধাতুর পাশাপাশি বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে যাচ্ছে ডায়িং কারখানার বর্জ্যও। ওয়াশিং মালিক সমিতির দেয়া তথ্য বলছে, প্রতিদিন ২৪ থেকে ৩০ লাখ লিটার বর্জ্য পানি সরাসরি অপরিশোধিত অবস্থায় গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। শ্যামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক প্রিন্টিং অ্যান্ড নিট-ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ৩০ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা সরাসরি মিশছে নদীটির পানিতে।

 

নদী দূষণের এমন ভয়াবহতার ফলে জীব বৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে বাস্তুসংস্থান। প্রভাব পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরও। নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনে। নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। সংকোচিত হয়ে আসছে এর আকার।

 

ফলে নদীর অববাহিকা অঞ্চল এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। অতিমাত্রায় দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত নদী এলাকায় ইলিশের বিচরণ কমেছে। যে কারণে দেশের মত্স্য সম্পদের বিচরণস্থলও সংকোচিত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ইলিশের অভয়াশ্রম মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে ভোলার নদী অঞ্চলে। এসব এলাকায় দূষণ এখনো কম। তবে নদী দূষণের যে চিত্র আমরা দেখছি, তাতে আগামীতে এ অঞ্চলের ইলিশ উত্পাদনের ওপর তার যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

 

অন্যদিকে দূষণের কারণে নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, পাঙাশ, বাটা, সরপুটি, গলদা, বাগদা, চাকা চিংড়ি, বোয়াল, আইড়, শোল, গজার, টাকি, শিং, মাগুর বা কৈ মাছ উত্পাদনে আগের সেই প্রাচুর্যতাও হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যাচ্ছে নদ-নদীর অনেক মাছ। এ অবস্থায় জেলে সম্প্রদায়সহ নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন জীবিকা যেমন দূরূহ হয়ে উঠছে, তেমনি দেশের মানুষ প্রাকৃতিক মাছের সাধ আর সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।

 

এ মাসেই গাজীপুরের শ্রীপুরের বানার নদ ও সুতিয়া নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠে। মাঝে মাঝে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে কর্ণফুলীসহ দেশের অন্যান্য নদীতেও। ফলে নদীকেন্দ্রিক যাদের রুটি-রুজি ছিল। যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এমন লোকজন অন্যত্রে ছুটতে বাধ্য হয়েছে। দূষণের মাত্রার কারণে নদীর আশাপাশের ফসলি জমিতে এখন আর আগের মতো চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষি কাজ করা মানুষও কর্মহীন হয়ে পড়ছে। আবার নদীর পানি ব্যবহার করে যেসব ফসল উত্পাদন হচ্ছে, সেসব ফসলেও থেকে যাচ্ছে এসব ভারী বর্জ্যের বিষাক্তের প্রভাব। ফলে এসব খাদ্য খেয়ে মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি রোগ দেখা দিচ্ছে।

 

নদী দূষণ রোধে বিশেষত বুড়িগঙ্গার দূষণ কমাতে হাজারিবাগের ট্যানারি সরানো নিয়ে কম জল খোলা হয়নি। দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের পর ট্যানারি শিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ট্যানারির দূষণ বন্ধ হয়নি। নতুন করে দূষিত করছে ধলেশ্বরীর নদীকে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেটি নিয়ম না মেনে চালানোর অভিযোগ তুলেছে খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরই। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

 

গত ২৯ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী নদীর পানি ও সিইটিপি থেকে বের হওয়া বর্জ্য পরীক্ষা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। যেখানে ক্ষতিকর ১১টি উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেখতে পেয়েছে। এর মধ্যে আছে পানির তাপমাত্রা, ক্ষারের পরিমাণ, দ্রবীভূত অক্সিজেন কম থাকা, বিদ্যুত্ পরিবাহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, জৈব রাসায়নিক উপাদান, যা ধলেশ্বরীর জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ভাবে প্রভাব ফেলছে। অথচ ট্যানারির দূষণকে পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যই সাভারের ট্যানারি পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এর সুফল পাচ্ছে না নদী। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, স্থায়ী ট্যানারি পল্লী স্থাপনের পরও কেন দূষণ বাড়ছে। দায়টা তাহলে কার? উত্তরটা মোটামুটি সহজ। এগুলো যাদের দেখভালের দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে তাদের গাফিলতি আছে। সিইটিপি ব্যবহারের নামে কর্তাব্যক্তিদের চোখে ধুলো দেয়া চেষ্টা চলছে। নিয়ম মেনে সেটি পরিচালনা হচ্ছে না। অথবা পরিচালনার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্ষতির শিকার হচ্ছে নদী। প্রাণ-প্রকৃতি। 

 

বছরের পর বছর ধরে আমাদের চোখের সামনে নদী দূষণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নদীর প্রতিবাদের ভাষা নেই। যারাও মাঝেমধ্যে নদী দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তারাও কর্তৃপক্ষের নামকাওয়াস্তে উদ্যোগের কারণে ঝিমিয়ে পড়েন। অথচ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি) হিসেবে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো মানুষ বা প্রাণীদের মতো আইনি অধিকার পায়। কিন্তু নদীর পক্ষে যাদের লড়াই করার কথা তারাই অনেক সময় থাকেন নির্বিকার। নদীর তীরবর্তী কারখানা, ইপিজেডগুলোতে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থেকে তাই দূষণ ছড়িয়ে পড়ে নদীতে, শহুরে ও গ্রামে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা বিশ্বজুড়েই চলছে। তবে নদীকে রক্ষা করেই। নদীর প্রাণ-প্রকৃতি ধরে রেখেই। সেই প্রতিযোগিতায় আমরা আর কতকাল পিছিয়ে থাকব? জীবন্ত সত্তা হলেও নদী তার দূষণের কথা বলতে পারে না। প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই বলে কী আমরা নদীর কান্না শুনবো না

 

লেখক: সংবাদকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন