সত্যজিৎ ছিলেন নিভৃত মানুষ

আমি প্রথমবার পথের পাঁচালী দেখেছিলাম ১৯৫৬ সালে, কলকাতায়। আমি গিয়েছিলাম জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে আমার কলেজকে রিপ্রেজেন্ট করতে। আমার চাচা ছিলেন একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। তিনি আমাকে সত্যজিৎ রায় নামের একজন তরুণ পরিচালকের নতুন ছবিটি দেখতে বলেছিলেন। এরপর একদিন গিয়ে হলে ঢুকলাম ছবিটা দেখার জন্য। সেদিন ছবিটির চারটি শো দেখার পরই বের হয়েছিলাম। পরের কয়েক দিনে আমি ছবিটি এক ডজনেরও বেশিবার দেখেছি। সেবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমার পথ যেন সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হলো যেন আমাকে আঘাত করা হয়েছে। ছবিটা যেন আমাকে কিছু বলেছিল। দারুণ প্রেরণা পেয়েছিলাম। আমি সবসময়ই একজন নির্মাতা হতে চেয়েছিলাম।

পথের পাঁচালী দেখে আমি পরিচালক হওয়ার সিদ্ধান্তটা পাকা করে ফেললাম। নির্মাতা হওয়ার পর আমার প্রথম ছবি অংকুর (১৯৭৪) দেখার জন্য চিঠি লিখেছিলাম সত্যজিৎ রায়কে। তিনি দেখেছিলেন এবং তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছবিটা নিয়ে আমার প্রত্যাশা কী। তাকে বলেছিলাম যে আমি চাই যেন ছবিটা মুম্বাইয়ের ইরোজ সিনেমায় অন্তত এক সপ্তাহ চলে। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ছবিটা কয়েক সপ্তাহ চলবে এবং সত্যিই তেমনটা হয়েছিল।

এর পর থেকে আমার সিনেমা নিয়ে তার মন্তব্য চাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। যেকোনো কাজ নিয়ে অন্যের কাছ থেকে প্রকৃত মূল্যায়ন পাওয়াটা বেশ কঠিন। বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া হয় সংক্ষিপ্ত, কারণ তারা বেশি বলতে চায় না। আর যদি বলেও তাতে আপনাকে খুশি করার চেষ্টা থাকবে। সমসাময়িকদের সঙ্গে সম্পর্কটা সবসময়ই সমস্যাজনক। কিন্তু মতামতের জন্য আপনি সবসময়ই সত্যজিৎ রায়ের ওপর আস্থা রাখতে পারতেন। কারণ তিনি যা মনে করতেন তা- বলতেন। তার মতামত ছিল তীক্ষ, লক্ষ্যভেদী। তিনি খুব বেশি তত্ত্ব কপচাতেন না। সে সময় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া ছিল পুনেতে আর মানুষ সিনেমাকে খুব বেশি তাত্ত্বিকভাবে দেখতে শুরু করেছিল। সত্যজিৎ রায় এমন সব গোঁড়ামি থেকে মুক্ত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটা গল্প বলার নানা রকম উপায় থাকতে পারে। তাকে নিয়ে ১৯৮১ সালে আমি একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম দূরদর্শনের জন্য। মুম্বাই কলকাতায় শুটিং করতে আমার দেড় বছর সময় লেগেছিল। তিনি ব্যস্ত ছিলেন তার ঘরে বাইরে ছবির কাজে আর আমি তখন নির্মাণ করছিলাম আরোহণ। আমার ছবিটি ছিল পশ্চিম বাংলার তখনকার বামপন্থী সরকারের উন্নয়ন মডেলে গ্রামীণ সংগঠনগুলোর ভূমিকা। সেটে ঢুকে যাওয়াটা অনেক পরিচালকই পছন্দ করতেন না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় কিছু মনে করতেন না। আমরা ফাঁকে ফাঁকে প্রামাণ্যচিত্রের জন্য শুটিং করতাম। কিন্তু তার ক্ষেত্রে টুকরো টুকরো শটই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা অসাধারণ সৃষ্টিশীল মানুষটিকে একটু একটু করে আবিষ্কার করছিলাম। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, গ্রাফিক আর্টিস্ট, কম্পোজার। তিনি টাইপফেস, এমনকি সেটও ডিজাইন করতেন। তিনি ছিলেন একাই একশ। এটা সত্য যে তার সঙ্গে অনেক প্রতিভাবান মানুষও কাজ করেছেন। এর মধ্যে দুজন পরবর্তী সময়ে আমার সঙ্গেও কাজ করেছেনএকজন ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র তার প্রডাকশন ডিজাইনার বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের সময় তিনি আমার সঙ্গে অনেক ধৈর্য দেখিয়েছেন। একই প্রশ্নের জবাব তিনি বহুবার দিয়েছেন। আর এসব প্রশ্নের তিনি আগেও জবাব দিয়েছেন। কারণ বহু মানুষ তার সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। তিনি সবসময় কথা বলতেন তার নিজস্ব অবস্থান থেকে। অনেক শিল্পীই এটা পছন্দ করতেন না। কারণ তারা এমন অবস্থানে দাঁড়াতে পছন্দ করতেন না, যেখানে তাদের সহজেই আক্রমণ করা যায়। কিন্তু তার কাজ নিয়ে অন্যরা কী বলছে তা তিনি জানতেন। কিন্তু সেসব তিনি পাত্তা দিতেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন নিজের মতো করে।

সত্যজিৎ রায় ছিলেন নিভৃত মানুষ। তিনি সবসময় আপনাকে একটু দূরে রাখতেন। তার পরিচিত মানুষ ছিলেন অনেকে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ ছিলেন অল্প কয়েকজন। প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ হওয়ার পরও আমি অনেকবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। মনে আছে একবার চা খেতে গিয়েছিলাম তার বাসায়। আমাকে বলা হয়েছিল যেন তার সময় নষ্ট না করি। তাই ঠিক ৫টায় গিয়ে হাজির হই। আমাকে পরিবেশন করা হয় তার পছন্দের একটা নির্দিষ্ট চা বাগানের মাকাইবারি চা। আমরা সিনেমা, জীবন এবং সবকিছু নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। কথা শেষ হতে হতে দেখি তখন রাত ৯টা বাজে। তার স্ত্রী আমার ওপর রাগ করেছিলেন। কারণ আমি রায়ের রাতের খাবারে দেরি করিয়ে দিয়েছিলাম।

সত্যজিৎ রায় তার প্রাথমিক জীবনে দুভাবে সিনেমাকে আত্মস্থ করেছেন। প্রথমত, ১৯৪৭ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার মাধ্যমে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর যখন ১৯৫০ সালে তিনি লন্ডনে ডিজে কেমারের জন্য একজন গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন। তিনি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অনেক সময় কাটাতেনএখানে তিনি অনেক ছবি দেখেছেননির্দিষ্ট করে বললে তিন মাসে ৯৯টি ছবি। এর মধ্যে ছিল সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের ছবি। এটা ছিল সিনেমা নিয়ে তার শিক্ষাগ্রহণের অংশ। আমি এখনো বিশ্বাস করি, সিনেমা নিয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতি নেই। সমালোচকের দৃষ্টি থেকে বলতে হয়, আপনাকে নিজস্ব সিনেমাটিক স্বর নির্মাণ করতে হবে। সিনেমা কীভাবে সৃষ্টিশীলতা চিন্তা ধারণের জায়গা হয়ে ওঠে, সেটা আবিষ্কার করতে হবে।

সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন, ভারতীয় সিনেমার উত্কর্ষ কতটা হতে পারে। তার ছবির ভারতীয় সিনেমার নন্দনভাবনা নিয়ে ধারণা হাজির করে। নিউ ওয়েব যদি ফরাসি সিনেমার আকিরা কুরোসাওয়া জাপানের ছবির সেরাটা প্রকাশ করে, তাহলে বিশ্বের সামনে ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে সেটা সত্যজিৎ রায়।

 

শ্যাম বেনেগাল: চলচ্চিত্র পরিচালক চিত্রনাট্যকার

লেখাটি সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত

ওপেন ম্যাগাজিন থেকে ভাষান্তর: এস এম রশিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন