কর ব্যবস্থার সংস্কার

আন্তর্জাতিক করপোরেট করারোপ বিষয়ে খোলা চিঠি

হোসে আন্তোনিও ওকাম্পো, জোসেফ স্টিগলিৎজ, জয়তী ঘোষ

প্রিয় প্রেসিডেন্ট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার নির্বাচিত হওয়াকে বিশ্ব স্বাগত জানিয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে আবারো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা জোরদারের প্রতিশ্রুতিকেও স্বাগত জানিয়েছে। একটি সমতামূলক পরিবেশসম্মত টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের শর্ত সৃষ্টিতে সরকারগুলোকে সমবেত করতে আপনার নেতৃত্ব রূপান্তরমূলক পরিবর্তন উৎসাহিত করতে পারে।

অনেক দিন ধরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বায়নের অন্যতম খারাপ দিকটি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তা হলো, বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর কর ফাঁকি। যে ধরনের সমাজের আকাঙ্ক্ষা আমরা করি, তা বিনির্মাণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর ন্যায্য করারোপ প্রয়োজন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবার উচ্চ জীবনমান নিশ্চিতে যেকোনো প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার এটি অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হতে হবে। করপোরেট কর ফাঁকির অবসান সম্পদ আয়ে ব্যাপকতর অসমতা মোকাবেলার অন্যতম ভালো উপায়ও বটে।

কর অবকাশকেন্দ্রগুলোয় মুনাফা স্থানান্তরের মাধ্যমে বড় কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে প্রতি বছর অন্তত ২৪০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব বঞ্চিত করে। রাজস্বের ঘাটতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রে (যেখানে মার্কিনভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশ বৈদেশিক উৎসজাত মুনাফা কর অবকাশ কেন্দ্রগুলোয় প্রবাহিত হয়) নয়, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয়ও (যেখানে রাজস্ব আহরণের উৎস সীমিত) ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।  

ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের (আইসিআরআইসিটি) সদস্য হিসেবে আমরা আপনাকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেয়া, অবৈধ কর অবকাশ কেন্দ্রগুলো খুঁজে বের করা, পাচার হওয়া সম্পদ জব্দ করা এবং সম্মুখ কোনো অজ্ঞাত কোম্পানির আড়ালে নিজ জনগণের সম্পদ চুরিতে জড়িত নেতাদের জন্য তা আরো কঠিন করে তোলার প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানাই। এজন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর ন্যায্য করারোপ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থার সংস্কারের চলমান প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে আপনার প্রশাসনের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত, যেটি বর্তমানে জি২০ এখতিয়ারভুক্ত ওইসিডি প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব আলোচনা ভালোভাবে এগোয়নি। শীর্ষ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর (আগের মার্কিন প্রশাসনসহ) সরকারগুলো একটি ভুল অনুমানের ভিত্তিতে আলোচনা করেছে যে নিজ নিজ দেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তর অবস্থিত, তাদের দ্বারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়। ফলে আন্তর্জাতিক করারোপের বিধান সংস্কারের আলোচনাগুলো এভাবে লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতকের আকাঙ্ক্ষা বা বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়েছে।

এখনো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি অব্যাহত রেখেছে, যা মহামারী-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। বিশ্ব এর অভিঘাত সহজেই পোষাতে পারবে না।

তবে আলোচনা প্রক্রিয়ায় এই ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে একক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর অর্থ হলো, প্রতিটি দেশে তাদের বাস্তব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক মুনাফার ওপর করারোপ করা উচিত। এটি যুক্তরাষ্ট্রে একটি পরিচিত ধারণা, যেখানে একটি ফর্মুলার ভিত্তিতে করপোরেট মুনাফা বণ্টন হয়। আর সেক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য ফ্যাক্টর হলো, মুনাফা সৃষ্টিকারী কর্মসংস্থান, বিক্রয় সম্পদ। তবে বর্তমান প্রস্তাব বড় প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক মুনাফার কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশেরবিশেষ করে মার্কিনভিত্তিক ব্যাপকভাবে ডিজিটাইজড বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপরএই মানদণ্ড প্রয়োগের কথা বলে।  

চলতি মহামারীতে প্রায় তিনগুণ -কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করেছে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে কেবল ডিজিটাল মাল্টিন্যাশনাল নয়, বরং সব বহুজাতিক কোম্পানির ডিজিটাল বিজনেস অপারেশনের ক্ষেত্রে ন্যায্য কর প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। অতএব, আন্তর্জাতিক পরিসরে মার্কিন ব্যবস্থার অনুসরণে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যাপকতর সংস্কার করতে হবে; আর তা করতে হবে ডিজিটাল নন-ডিজিটালের মধ্যে কোনো বিভাজন না রেখে। ধরনের নীতি একটি অধিক সমতল ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা, বাজার বিকৃতি কমানো, কর ফাঁকির সুযোগ সীমিত করা এবং বহুজাতিক বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা জুগিয়ে সাহায্য করবে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর ন্যূনতম করারোপ, দেশগুলোর মধ্যে ক্ষতিকর কর প্রতিযোগিতার অবসান এবং কর অবকাশ কেন্দ্রগুলোয় মুনাফা প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবস্থা সমর্থিত হওয়া উচিত হবে। তবে ওইসিডি অন্যত্র যে ১২ দশমিক শতাংশের ন্যূনতম হারের বিষয় আলোচিত হচ্ছে, তা বৈশ্বিক ঊর্ধ্বসীমা হতে পারে। উল্লিখিত হারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে কর বহনে বাধ্য করতে নেয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ কর ফাঁকির অবসান ঘটাতে পারে বৈকি।  

আপনার নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক করপোরেশনগুলোর বৈদেশিক আয়ের (জিআইএলটিআই নামে পরিচিত) ওপর ন্যূনতম মার্কিন কর ২১ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। পদক্ষেপ কেবল আপনার দেশের আর্থিক রাজস্ব বাড়ানোয় সুফল দেবে তা নয়, বরং এটি অন্য দেশের নীতিনির্ধারকদেরও অনুসরণে রাজনৈতিক সমর্থন জোগাবে। 

একটি বৈশ্বিক ন্যূনতম হারে করারোপ কর ফাঁকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গেম চেঞ্জার হতে পারে। যদি জি২০ দেশগুলো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ হারে ন্যূনতম করপোরেট কর (যেমনটা আইসিআরআইসিটি জোর দেয়) আরোপ করে, তাহলে ৯০ শতাংশের বেশি বৈশ্বিক মুনাফা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২৫ শতাংশ বা তারও বেশি কর হিসেবে কাটা যাবে। অবশ্যই হ্যাঁ, এটি জরুরি যে ধরনের কোনো কর প্রতিষ্ঠানের নিজের দেশ স্বাগতিক (হোস্ট) দেশের মধ্যে ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে নির্ণীত হতে হবে। 

অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন তার কনফারমেশন হিয়ারিংয়ে বলেছেন, আপনার প্রশাসন করপোরেট করারোপ ধ্বংসাত্মক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থামাতে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে আগ্রহী। কোনো প্রমাণ নেই যে নিম্ন করপোরেট করহারের সাম্প্রতিক প্রবণতা উৎপাদনশীল বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি উদ্দীপ্ত করেছে। ২০১৭ সালের করহার কমানো প্রধানত লভ্যাংশ প্রদান শেয়ার পুনরায় অধিগ্রহণে (স্টক বাইব্যাকস) তহবিল জোগাতেই পর্যবসিত হয়েছে।

করপোরেট কর কেবল মুনাফার ওপর কার্যকর করা হয়। কাজেই করহার কমালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অন্য কথায়, করপোরেট কর আবশ্যিকভাবে লভ্যাংশের ওপর একটি উইথহোল্ডিং কর এবং এভাবে সম্পদশালীদের ওপর আয়কর আরোপ সমমূলধন ধারণের কারণে (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে  যেমন পেনশন ফান্ড) আয়ের চেয়ে আরো অসমভাবে বণ্টিত হয়।

আমরা আপনাকে এটা বলতে চাই যে আপনার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আবারো ক্ষমতার উদাহরণ হোক এবং যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বের জন্য ন্যায্য সমতামূলক হবে ধরনের ব্যাপকতর সংস্কারে ইচ্ছুক অন্য দেশগুলোকে সহযোগিতা করুক। ধরনের সমতামূলক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত যেসব দেশ এরই মধ্যে ডিজিটাল ব্যবসার ওপর কর আরোপে সিদ্ধান্ত নিয়েছে (বাড়তি রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকেই) তাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য অবরোধ প্রতি-উৎপাদনমূলক হবে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর করারোপ একটি দুর্বল আন্তর্জাতিক আপস মেনে নিয়ে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার সঙ্গে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়া ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনবে না, বরং আস্থায় চিড় ধরাবে। একটি টেকসই, সহযোগিতামূলক মহামারী-উত্তর ন্যায্য বিশ্ব বিনির্মাণের ক্ষমতা পুরোপুরি আমাদের হাতে, যেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর যেটুকু কর দেয়া উচিত ততটুকু দেবে। এই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে আপনার প্রশাসনকে যেকোনো পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে আইসিআরআইসিটি হাত বাড়িয়ে দেবে, এগিয়ে আসবে।

 

হোসে আন্তোনিও ওকাম্পো: কলম্বিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী; জাতিসংঘের অর্থনৈতিক সামাজিক বিষয়াদির সাবেক উপমহাসচিব; কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের (আইসিআরআইসিটি) প্রধান

জোসেফ স্টিগলিত্জ: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের (আইসিআরআইসিটি) সদস্য

জয়তী ঘোষ: ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের (আইসিআরআইসিটি) সদস্য

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন