পাঁচ দশক পরে মার্কিন বাহিনীর দ্বিতীয় পরাজয় কি

সাইফ বাপ্পী

ভিয়েতনাম থেকে সর্বশেষ মার্কিন সৈন্যটিকে সরিয়ে নেয়া হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। তত্কালীন উত্তর দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুরো অংশজুড়েই তখন প্রায় দুই দশকের ওই যুদ্ধের দগদগে ক্ষত। ক্ষতি কম হয়নি যুক্তরাষ্ট্রেরও। যুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে ভিয়েতনামে লড়াই করেছে ২৭ লাখেরও বেশি মার্কিন সৈন্য। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৮ হাজার সৈন্য। আহত হয়েছে তিন লাখেরও বেশি। এর পরও তত্কালীন সায়গন (বর্তমান হো চি মিন সিটি) থেকে শেষ মার্কিন সৈন্যটি দেশে রওনা হয়েছিল পরাজয়ের গ্লানি মাথায় করেই।

সেখানে উপস্থিত সায়গনের মার্কিন সমর্থিত সরকারের প্রতিনিধিদের মুখে ছিল তখন দুশ্চিন্তার ছাপ। উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়া হারিয়ে অনেকটা অসহায় বোধ করছিলেন তারা। উত্তর ভিয়েতনামিদের হাতে রাজধানী সায়গনের পতন তখন নিশ্চিত। অন্যদিকে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা হাসছিলেন বিজয়ের হাসি।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক পর্যবেক্ষকদের চোখে প্রায় ৪৮ বছর পর এখন সে দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দুই দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অনেকটা খালি হাতেই আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হচ্ছে মার্কিন সৈন্যদের। বিষয়টি কাবুলের মার্কিন সমর্থিত সরকারের প্রতিনিধিদের কপালে ফেলে দিয়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। অন্যদিকে তাদের প্রতিপক্ষ তালেবানরা এরই মধ্যে বিজয়ের উল্লাস শুরু করে দিয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিকে ঐতিহাসিক বিশ্লেষকরা আখ্যা দিচ্ছেন আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম দেজা ভ্যু হিসেবে।

মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনাম ত্যাগ করার পরও দেশটিতে যুদ্ধ চলেছে। সায়গন দখলের মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনামিদের দেশটির পুনরায় একত্রীকরণ সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে আরো দুই বছরের বেশি। কিন্তু ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী এতটা সময় লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে কিনা সে বিষয় নিয়েও নিরাপত্তা বিশ্লেষক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

তাদের ভাষ্যমতে, ভিয়েতনাম আফগান যুদ্ধে মার্কিনদের প্রতিপক্ষের ধরন ছিল ভিন্ন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফলাফল একই থেকে যাচ্ছেসামরিক রাজনৈতিক ব্যর্থতা। আফগান যুদ্ধে পর্যন্ত সোয়া লাখ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় প্রাণক্ষয়ের পরও আফগানিস্তানে দৃঢ় কোনো শাসন ব্যবস্থা দাঁড়ায়নি। উপরন্তু কয়েক দশকের যুদ্ধাবস্থা দেশটির গোটা শাসন ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে তুলেছে। সেখানকার গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাই দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত। অন্যদিকে দেশটির সরকারও রাজনৈতিক সামরিক দুদিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

অন্যদিকে সাবেক সায়গনের দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই মূল্যায়ন ঐতিহাসিকদের। তারা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর আগে সেখানে কয়েক দফায় অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান সরকার বদলের ঘটনা ঘটেছে। এর কোনো কোনোটিতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থনও দিয়েছে। দুর্নীতিসহ নানা ভ্রষ্টাচারের অভিযোগ ছিল সেখানকার সরকার শাসন ব্যবস্থা নিয়েও।

দক্ষিণ ভিয়েতনামে সায়গনের সরকারকে দেখা হতো যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার হিসেবে। গত কয়েক বছরে কাবুলের সরকার সম্পর্কে অনেকটা একই বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে তালেবানরা। তাদের দাবিকে আরো জোরালো করে তুলেছে কাবুলের অতিমাত্রায় ওয়াশিংটন নির্ভরতা।

বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে খোদ মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক, পর্যবেক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। বোস্টন গ্লোবের সাবেক সাংবাদিক গ্রন্থকার এইচডিএস গ্রিনওয়ে সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি যুদ্ধে হেরে যাওয়ার কারণ তিনটি। প্রথমত, উভয় ক্ষেত্রে আমাদের ক্লায়েন্টরা (সায়গন কাবুল) যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, আর্টিলারিসহ যান্ত্রিক লড়াইয়ের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ সবসময়ই গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে, যে বিষয়ে তারা বেশ দক্ষও ছিল। দ্বিতীয়ত, আমাদের ক্লায়েন্টদের শক্তি বাড়ানোর যাবতীয় প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে দুর্নীতি। কারণেই দক্ষিণ ভিয়েতনাম আফগানদুই সরকারই আস্থার সংকটে ভুগেছে। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের ক্লায়েন্টরা কখনই বিদেশীদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া পুতুল সরকারের ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যেখানে প্রতিপক্ষ খুব সহজেই নিজেদের ঔপনিবেশিক দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের চোখে আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যর্থতার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। তালেবানদের উত্খাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হয়। সামরিক-বেসামরিক উভয় প্রশাসনেই উদ্যোগ নেয়া হয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার। অন্যদিকে তালেবানদের দমনের জন্য গৃহীত সামরিক-বেসামরিক প্রায় সব পদক্ষেপই হয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ তথা পেন্টাগনের তত্ত্বাবধানে। এক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নাগরিক সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর পরিবর্তে সামরিক দিকগুলোই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ফলে বেসামরিক প্রশাসন একদিকে যেমন অদক্ষ থেকে গিয়েছে, তেমনি দূরে সরে গিয়েছে জনসাধারণ থেকেও।

ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসের মডার্ন আমেরিকান হিস্ট্রি জার্নালের এক সাম্প্রতিক গবেষণা নিবন্ধে -সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনার উদাহরণ টানা হয়। এতে বলা হয়, তালেবানদের উত্খাতের পর মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আফগানিস্তানের পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তবে প্রশিক্ষণ থেকে খুব একটা লাভ হয়নি। ২০১০ সালে গোলাম ফারুক নামে এক আফগান পুলিশ সদস্য তার প্রশিক্ষণ সম্পর্কে বলেন, আমি এখন জানি কীভাবে গুলি করতে হয়। কিন্তু আমি সত্যিকারের পুলিশের কাজ শিখতে চেয়েছিলাম। কীভাবে তল্লাশি চালাতে হয়, তদন্ত করতে হয়, জনগণের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, আমাদের কাজের আওতা বা ক্ষমতা কতটুকুএগুলোই শিখতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তারা আমাদের সেসব শেখায়নি। আরেক পুলিশ সদস্যের ভাষ্য হলো, আমরা লড়াই চালানোর বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু প্রকৃত পুলিশের কাজ কী সে বিষয়ে আমরা কিছুই শিখিনি

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পুলিশকে দিয়ে সামরিক কাজ করানোর বিষয়টি সাধারণ আফগান নাগরিকদেরও বেশ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। ২০১৪ সালে এক আফগান ব্যবসায়ীর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ছিল, যতবারই শুনি কোনো অভিযানে পুলিশের মৃত্যু হয়েছে ততবারই আমার প্রশ্ন জাগে, তাহলে মিলিটারি কী করছে? বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করা তো পুলিশের কাজ না।

অন্যদিকে আফগান এক পুলিশ কর্মকর্তা পশতুন আতিফও লিখেছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন প্রশিক্ষণের ফলাফলকে পুলিশি কার্যক্রমের সামরিকায়ন ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। এখানে সুরক্ষা দেয়ার পরিবর্তে হত্যা করার উপযোগী করে প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে কর্মকর্তাদের ধ্যানধারণাও হয়ে উঠেছে অনেকটা সামরিক গোছের। তাদের মধ্যে এমন বিশ্বাস তৈরি হয়েছে নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের প্রয়োজনে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেয়ে শত্রুকে হত্যা করাটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু পুলিশ নয়, শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রেই মার্কিন প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান কাবুলের প্রশাসনকে জনসাধারণ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কাবুল প্রশাসনের অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকেও। বিষয়টিতেও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ২০০২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের যাবতীয় উন্নয়ন পুনর্গঠন কার্যক্রমের দুই-তৃতীয়াংশেরই দেখভাল করেছে পেন্টাগন। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের অবদান ছিল শতাংশেরও কম। এসব অবকাঠামো পুনর্গঠন কার্যক্রমে জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে সামরিক দিকগুলোই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ফলে এগুলো উন্নয়ন অবকাঠামো না হয়ে রূপ নিয়েছে নিরাপত্তা অবকাঠামোয়।

এসবেরই ধারাবাহিকতায় কাবুলের প্রশাসন সাধারণ আফগান থেকে দূরে সরে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে অভিমত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, কয়েক দশক আগে ভিয়েতনামেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল।

অনেক ক্ষেত্রেই মিল থাকলেও কিছু বিষয়ে অমিল রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিষয়ে তাদের ভাষ্য হলো, ভিয়েতনামের উভয় অংশেই জনসাধারণ শুরু থেকে মার্কিনদের দখলদার হিসেবে দেখেছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের শুরুর দিকের ভাবমূর্তি ছিল গোঁড়া-কট্টর পশ্চাদমুখী তালেবানি শাসন থেকে মুক্তিদাতা হিসেবে। কিন্তু দীর্ঘ উপস্থিতিসহ আরো নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ভিয়েতনাম আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষদের মধ্যে ধরন আদর্শগত ব্যবধানও প্রায় আকাশ-পাতাল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন