মোস্তফা গ্রুপ

ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ১৭৪ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় এক সময় দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ছিল মোস্তফা গ্রুপ। পারিবারিক কোন্দলসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রডাক্টস লিমিটেডের নামে নেয়া ১৭৪ কোটি টাকা ঋণ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আর সেই ঋণ জালিয়াতির জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল অভিনব এক উপায়। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে সেসবও। তদন্ত শেষে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সংস্থাটির উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।

কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই বিষয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে বলে বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। তিনি বলেন, মোস্তফা গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে নানা তথ্য-প্রমাণ তাদের তদন্তে উঠে এসেছে। সেসবই তদন্ত প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মোস্তফা গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা করা হয়। এতে আসামি করা হয় ১১ জনকে। আসামিদের মধ্যে মোস্তফা গ্রুপসংশ্লিষ্ট ছিলেন নয়জন, বাকি দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এমএম ভেজিটেবল অয়েল চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে অবস্থিত। এটি মূলত সয়াবিন পাম তেলের পরিশোধনাগার বা রিফাইনারি প্লান্ট। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটি গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিংকে দুটি ঋণপত্র বা এলসি দেয়। দুটি এলসির মূল্যমান ছিল যথাক্রমে ৫৪ কোটি ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ২৫ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা। গ্লোব লুসিডা ট্রেডিং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডকে (বিডিবিএল) জানায় যে তারা ঋণপত্রের শর্ত অনুসারে এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রডাক্টসকে যথাযথ মালামাল দিয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের পাওনা টাকা এমএম ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানিকে হস্তান্তর করে বিডিবিএল। পরে টাকা অন্য দুটি ব্যাংকে স্থানান্তরের মাধ্যমে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।

তবে যে দুটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিডিবিএল অর্থ ছাড় করেছে, সেই মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিং নামে বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বলে দুদকের তদন্তে উঠে আসে। জানা যায়, মূলত দুটিই মোস্তফা গ্রুপের কাগুজে প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ করে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে দুদক বিষয়টির সত্যতা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির খোঁজে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও চিঠি দেয় দুদক। তারাও দুটির সন্ধান দিতে পারেনি। পাশাপাশি বিডিবিএলের তিন সদস্যের একটি দল সরেজমিন পরিদর্শন করেও প্রতিষ্ঠান দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব ট্রাকের মাধ্যমে মালামাল পরিবহন করা হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে, সেগুলোরও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা লিবার্টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামে কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাননি। বিডিবিএলের তিন সদস্যের দলও প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব পায়নি বলে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করে মালামাল দেয়া তা গ্রহণ করা হয়েছে দেখিয়ে বিডিবিএল থেকে টাকা অন্য দুটি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। পরে তা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

অভিযুক্ত মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল আদতে মোস্তফা গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তদন্তে দেখা যায়, মোস্তফা গ্রুপ আরেকটি ব্যাংকে ঋণ রিশিডিউল আবেদনে গ্লোব ইন্টারন্যাশনালকে তাদের সিস্টার কনসার্ন হিসেবে উল্লেখ করেছে।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিং যদি মালামাল প্রকৃতপক্ষে এমএম ভেজিটেবল অয়েলকে দিয়ে থাকে, তাহলে মালামাল প্রদানের বিপরীতে বেনিফিশিয়ারি ব্যাংককে এমএম ভেজিটেবল অয়েলের ব্যাংক বিডিবিএল থেকে টাকা পরিশোধ করার কথা। বিডিবিএল সময়মতো টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু সেই অর্থ বিডিবিএল থেকে অন্য ব্যাংক দুটিতে যেদিন পরিশোধ করা হয়েছে, তার পরের দিনই বেশির ভাগ অর্থ আবার এমএম ভেজিটেবলের হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। অর্থাৎ মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিং মূলত মোস্তফা গ্রুপেরই কাগুজে প্রতিষ্ঠান। তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিডিবিএল থেকে ১৭৪ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ মানিলন্ডারিং করেছে।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিডিবিএল ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরী ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখায় ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেখানে হিসাব খোলে এমএম ভেজিটেবল। এর আগে এমএম ভেজিটেবল বিডিবিএলে কোনো এলসি খোলেনি। হিসাব খোলার পরই দুটি ৭৫ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়। আবার দুটি ছাড়া ব্যাংকটিতে কোনো এলসি খোলেনি তারা। এলসি দুটি খোলার পরের দিনই বেনিফিশিয়ারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিং সব মালামাল এমএম ভেজিটেবলকে দিয়েছে বলে তাদের ব্যাংকের সব রেকর্ডপত্র অ্যাকসেপ্টেন্স বা স্বীকৃতির জন্য বিডিবিএলে পাঠায়।

এসব মালামাল এমএম ভেজিটেবল গ্রহণ করেছে কিনা, দাখিল করা রেকর্ড সঠিক কিনা বা গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিংয়ের অস্তিত্ব আছে কিনা তা যাচাই না করেই এলসি খোলার পরের দিনই বিডিবিএল থেকে ৭৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দেয়া হয়, যা পরে আবার মোস্তফা গ্রুপ তাদের হিসাবে স্থানান্তর করে নেয়। সেই টাকাই এখন সুদসহ ১৭৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা হয়েছে বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে।

বিষয়ে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা বিডিবিএল ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরীকে কিছু প্রশ্ন করেন। তিনি জানতে চান, ৭৫ কোটি টাকার তেল পরিবহনের জন্য দুই শতাধিক ট্রাক লাগার কথা। বিপুল পরিমাণ পণ্য একদিনেই কীভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হলো? বিষয়টি ব্যাংক কর্মকর্তা খেয়াল করলেন না কেন? জবাবে পার্টিকে অন্ধবিশ্বাস করেছিলেন বলে জানান সৈয়দ নুরুর রহমান। নিজের ভুল স্বীকারও করেন তিনি।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল লুসিডা ট্রেডিং নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়ে একই কায়দায় মোস্তফা গ্রুপ প্রায় ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে, যা ফেরত দেয়ার মতো অবস্থা এখন আর তাদের নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন