কভিড মোকাবেলা

সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে

করোনা মহামারী থেকে জীবন রক্ষায় দেশে দেশে লকডাউন চলছে। এতে উৎপাদন-ভোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী কর্মসংস্থান হারিয়ে নতুন করে দারিদ্র্যের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এসব মানুষের জীবন রক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। অর্থনৈতিক স্থবির অবস্থায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মূল্যস্ফীতির। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই মহামারীর সময় জীবন বাঁচানোকে প্রাধান্য দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। উন্নত দেশগুলো সে পথ অনুসরণপূর্বক ব্যয় বাড়াতে থাকে। এতে সুফল মিলেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে পিছিয়ে রয়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রকাশিত (আইএমএফ) চলতি মাস পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় জিডিপি অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে একেবারে পেছনে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। অথচ করোনার কারণে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, কর্মচ্যুতিসহ নানা সামাজিক সংকট দেখা দিয়েছে।

রকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে খরচ বাড়াতেই হবে। যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় স্পেন্ডিং প্রায়োরিটি আর্থিক সংকট করোনার জন্য ঘনীভূত হয়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ এটাও বলছেন, এখন অর্থনীতিতে প্রণোদনা দেয়ার থেকে মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছানোটা অনেক বেশি জরুরি। তবে রাজস্ব আহরণ ভীষণভাবে অধোগতিতে। কিন্তু খরচ প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়েছে। এর সমন্বয় করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা তিনটি গ্রোথ ইঞ্জিনের কথা বলে থাকেন। তার মধ্যে একটি হলো বেসরকারি ভোগ। দ্বিতীয়টি, বেসরকারি ব্যয়। তৃতীয়টি হলো রফতানি। সবগুলোই এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে বিকল্প অর্থাৎ চতুর্থটি হলো সরকারি খরচ। সরকারি খরচ মানে সরকারি বিনিয়োগ এক্ষেত্রে ব্যয় মানে বাজারকে তেজি করার জন্য সরকারকে টাকা খরচ করতে হবে, যাতে বাজারে পণ্যের দাম বহাল থাকে। বাজারদরটাকে চাঙ্গা রাখা অর্থনীতিতে মুহূর্তে খুব জরুরি। কিন্তু সেখানে যদি চাহিদা না থাকে, বিক্রেতা যদি সঠিকভাবে দাম না পান, তাহলে সব দিক থেকেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়বে।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে গেলে যে ছোট মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকেই প্রাথমিকভাবে তাকাতে হবে, নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু ঋণের জোগান বাড়ালেই ক্ষুদ্র মাঝারি সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটবে কি? অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, শুধু ঋণের জোগান বাড়িয়ে বা শর্ত শিথিল করে এদের করোনা সংকট থেকে টেনে তোলা যাবে না। এজন্য আলাদা করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। মানুষ কাজ হারিয়েছে, কাজ কম পাচ্ছে, কম আয় করছে। ফলে যে মাত্রায় গতিশীল হওয়া দরকার অর্থনীতি, সেটি হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় না বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে না। এজন্য বেসরকারি বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে কর্মসৃজনমূলক প্রকল্প নিতে হবে সরকারকে। করোনা মোকাবেলায় সারা বিশ্ব কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়া বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা অন্যতম। বাংলাদেশকেও একই পথ অনুসরণ করতে হবে। তাছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশই আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখা এবং ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনা স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করেছে, যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত হয়, কর্মসংস্থান ঠিক থাকে এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ে। এখন প্রয়োজন এর কার্যকর বাস্তবায়ন।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে অর্থনীতির স্বাস্থ্য দ্রুত ফেরানো সম্ভব নয়। ক্রেতারা পণ্য না কিনলে কোম্পানিগুলো উৎপাদন করবে না। লোক নিয়োগ করবে না। বিনিয়োগও করবে না। কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য যদি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকে, তাহলে তারা নতুন ঋণ নিয়ে আয়তন বৃদ্ধি করবে কেন? কী করেই বা পুরনো ধার শোধ করবে? এর উল্টো যুক্তিও আছে। কেউ বলতে পারেন, বিধিনিষেধ উঠে গেলে ধীরে ধীরে কোম্পানিগুলো খুলবে, আবার উৎপাদন শুরু হবে, কর্মচারীরা তাদের বেতন পেতে শুরু করবেন। বেতন হাতে পেলে তারা পণ্য কিনতে শুরু করবেন, ফলে কোম্পানিগুলোরও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ থাকবে। তাই আলাদা করে চাহিদা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। অর্থনীতি যাতে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তার জন্য বরং জোগানের দিকটা আরো মসৃণ করা যেতে পারে। তাদের মতে, সহজ শর্তে ঋণ জোগান ব্যবস্থাকে মজবুত করে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ত্বরান্বিত করবে। আর জোগান ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেলে চাহিদা নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যবশত, ভাবনায় গলদ আছে। মানুষ তার আয়ের পুরোটা খরচ করে না, আয়ের একটা অংশ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। যে আয়টা সঞ্চিত হয়ে রইল, তার ঠিক সমান মূল্যের উৎপাদন কিন্তু ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি হবে না। সঞ্চয়ের কারণে জোগান চাহিদার মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে যাবে।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের চাহিদা কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সংকটের সময় কোনো উদ্যোক্তা সাহস করে বিনিয়োগ করবেন না। আর বিনিয়োগের চাহিদা না থাকলে সঞ্চয়ের অংশটা অবিক্রীতই পড়ে থাকবে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়ের অনুপাত বাড়বে আর তার সঙ্গে যেহেতু বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা কম, ফলে চাহিদায় ঘাটতি দেখা দেবে। সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় চাহিদা বাড়ানো। চাহিদা দুভাবে বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমত, মানুষের হাতে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের হাতে সরাসরি কিছু টাকা পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। গ্রহীতা টাকা ভোগ্যপণ্যের ওপর সরাসরি খরচ করে পণ্যের চাহিদা বাড়াবেন। দ্বিতীয়ত, সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে দেশে যে শুধু পণ্যের চাহিদা বাড়বে তা নয়, সরকারি বিনিয়োগের ফলে দেশের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটবে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও খানিকটা বাড়তে পারে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি, অমর্ত্য সেনসহ অনেকে বলছেন, সরকারের আর্থিক ঘাটতি কম রাখার চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই, মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছাতে হবে। হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি বাজারে মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ।

বাংলাদেশও একই পথ অনুসরণ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অপচয় রোধে সতর্কও থাকতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন