কভিড মোকাবেলায় সরকারি ব্যয়ে পেছনে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ

সুমন আফসার

মহামারী শুরুর পরে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। সময় কর্মসংস্থান হারিয়েছে অনেকে। আর্থিক সঞ্চয়ও নিঃশেষ হয়ে পড়ে বহু মানুষের। কভিডে ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে স্বাস্থ্যগত, আর্থিক বা খাদ্যসহায়তা দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার। প্রতিনিয়তই এসব পদক্ষেপের তথ্য সংরক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি মাস পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় জিডিপি অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে একেবারে পেছনে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ।

আইএমএফের তথ্যমতে, কভিড মোকাবেলায় বাংলাদেশের ব্যয় জিডিপির মাত্র দশমিক শতাংশ। ৪৬০ কোটি ডলারের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মাত্র ৪০ কোটি ডলার। অথচ কভিড মোকাবেলায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যয় জিডিপির দশমিক শতাংশ অর্থ আর পাকিস্তান পর্যন্ত ব্যয় করেছে জিডিপির শতাংশ।

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কভিড মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র জিডিপির ২৫ দশমিক শতাংশ, যুক্তরাজ্য ১৬ দশমিক , সিঙ্গাপুর ১৬, জাপান ১৫ দশমিক , জার্মানি ১১ চীন দশমিক শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে। এছাড়া থাইল্যান্ড জিডিপির দশমিক , মালয়েশিয়া দশমিক , কম্বোডিয়া দশমিক ফিলিপাইন দশমিক শতাংশ অর্থ কভিড মোকাবেলায় ব্যয় করেছে। এমনকি আফ্রিকার দেশ কেনিয়ারও খাতে ব্যয় দেশটির জিডিপির দশমিক শতাংশ।

কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসায় নাগরিকদের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। জানা গেছে, জার্মানিতে পুরো বেতন দিয়ে দেয়া হয়েছে কোম্পানিকে, বলা হয়েছে কোনো ছাঁটাই পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য। যুক্তরাজ্যে সরকার কর্মীর বেতনের ৮০ শতাংশ পরিশোধ করবে, বাকি ২০ শতাংশ দেবে কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্রে ছাঁটাই পদক্ষেপ নিলে বেকার পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যয় পর্যাপ্ত কিনা জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক . আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, গোটা পরিস্থিতিতে সংবেদশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল। একটা মানসিকতাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে, তা হলো রাজস্ব ঘাটতি যেন খুব বেশি না বাড়ে। আগামী বাজেটেও এমন ভুল করার শঙ্কা রয়েছে। তবে বর্তমানে বিশ্বের সব দেশ রাজস্ব ঘাটতির সীমা ভেঙেছে। কিন্তু আমরা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করেছি। প্রয়োজন ছিল সম্পূর্ণ নতুন কৌশল সুরক্ষা ব্যবস্থার। এটা সরকার করেনি।

কভিড-১৯- ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ খাদ্যসহায়তার ঘোষণা করে সরকার। প্রণোদনার মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকাই হলো ব্যাংকঋণ। রাজস্ব খাত থেকে নগদ অর্থসহায়তার ঘোষণা এসেছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির শতাংশেরও কম। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘোষিত প্যাকেজের আওতায় গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে, যা মোট প্যাকেজের ৫৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

আইএমএফের বিশ্লেষণ বলছে, রাজস্ব থেকে ঘোষিত প্রণোদনার মধ্যে উপকারভোগীদের মাঝে বিতরণ হয়েছে মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির অনুপাতে জনগণকে নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিশ্বের মধ্যে তলানিতেই রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রশমনের লক্ষ্যে শুরুতেই একগুচ্ছ আর্থিক সহায়তা-প্রণোদনার ব্যবস্থা করে সরকার। গত বছরের মার্চের শেষ নাগাদ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করা হয়। সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়।

গত বছরই অর্থ মন্ত্রণালয় দেশের রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য হাজার কোটির টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। প্যাকেজটি ছিল শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য। প্যাকেজের মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার ৪০ লাখ শ্রমিকের চার মাসের বেতন দেয়ার জন্য কারখানাগুলোকে ঋণ দেয়া হয়। প্রণোদনার অর্থ হিসেবে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণকৃত ঋণের ৬০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে সুদ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে সুদহার শতাংশ ধরে অর্ধেক সুদ সরকার বাকি অর্ধেক সুদ ঋণগ্রহীতাকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

গৃহহীনদের আবাসন পরিকল্পনার জন্য গত বছরের ১৫ এপ্রিল হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়। মহামারীর মধ্যে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েন তাদের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা, সম্মুখসারির সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্যবীমার জন্য ৭৫০ কোটি টাকা এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বোনাস হিসেবে আরো ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের সুদের চাপ কমাতে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণাও আসে। ফলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া আনুমানিক কোটি ৩৮ লাখ ঋণগ্রহীতা সরাসরি উপকৃত হন। এছাড়া করোনা প্রতিরোধে সুরক্ষা উপকরণ নমুনা পরীক্ষার কিট আমদানির ওপর আরোপ করে নেয়া সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)

করোনা মোকাবেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ বাড়ে স্বাস্থ্য, কৃষি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে। এসব খাতে বরাদ্দ ঠিক রাখতে সতর্কতা হিসেবে সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ২৫ শতাংশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কভিড-১৯ জরুরি প্রতিক্রিয়া মহামারী প্রস্তুতি প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে হাজার ৬৬০ কোটি টাকায় উন্নীত করে সরকার। মূলত করোনাভাইরাসের টিকা কেনা দেশের মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। এসবের বাইরে সরকার আরো দুটি আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর একটিতে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা এবং অন্যটিতে বৃদ্ধ, বিধবা তালাকপ্রাপ্ত নারীদের জন্য আরো হাজার ২০০ কোটি টাকার ব্যবস্থা করা হয়।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান . হোসেন জিল্লুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত সরকারের যে রেসপন্স, তাতে কভিডকে স্বল্পমেয়াদি সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। গত বাজেটেও কাঠামোগত কোনো রূপান্তর ঘটেনি। সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়েনি, বাড়েনি স্বাস্থ্য খাতেও। আর প্রণোদনার নামে যেসব প্যাকেজ দেয়া হয়েছে, সেগুলো ঋণনির্ভর। ধারণাগত জায়গা থেকে কভিডকে স্বল্পমেয়াদি সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে না হলেও এটিকে অন্তত মধ্যমেয়াদে বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। দ্রুত সমস্যা কেটে যাবে ভাবাটা যে সঠিক ছিল না তা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। যা করা হয়েছে, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

এদিকে করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে মার্চে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনস্টিটিউট (এডিবিআই) গত বছর করোনার শুরুতে গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের পাওয়া সহায়তার তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গত বছরের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলোর মাত্র ২৫ শতাংশ খাদ্য বা অর্থসহায়তা পেয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবার গড়ে হাজার ৪৪৭ টাকার অর্থসহায়তা পেয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলো জানিয়েছে, অধিকাংশ খাদ্যসহায়তাই এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। আর নগদ অর্থসহায়তা বেশি এসেছে ধনী আত্মীয়, প্রতিবেশী কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের পক্ষ থেকে। একই সময়ে কঠোর লকডাউন চলাকালে অর্থ খাদ্যসহায়তা পেয়েছে মাত্র ২৩ দশমিক শতাংশ পরিবার। এক্ষেত্রে একেকটি পরিবার গড়ে হাজার ৭৩৭ টাকা অর্থমূল্যের সহায়তা পায়।

নীতিনির্ধারকরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সংগত সঠিক কাজ করেছে। মহামারী ধরনের দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর মিছিল থামানো বা কমানোই প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়। আর সেই অগ্রাধিকারের প্রেক্ষাপটেই গোটা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলি, বর্তমানে যে ভীষণ ভয়ংকর অবস্থা বিরাজমান, পরিস্থিতিতে যথেষ্ট ব্যয় করার ক্ষমতা আদৌ আমাদের আছে কিনা তা বিবেচ্য বিষয়। আমরা কেবলই একটা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। অনেক ক্ষেত্রেই অনেক ঘাটতি আছে। তবে মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঘাটতি স্বাস্থ্য খাতে। খাতে অনেক বেশি ব্যয়ের প্রয়োজন। আমাদের যতটুকু সাধ্য আনুপাতিক হারে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় আমরা করেছি বলে আমরা ধারণা। তবে আমি কখনই বলব না যে প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় এটা যথেষ্ট। পরিস্থিতিতে কৌশল, সেটা আবার স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি এগুলো নির্ধারণ করার মতো অবস্থা থাকে না, বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়াতেই সব মনোযোগ ব্যস্ততা থাকে। মুহূর্তে প্রয়োজন আগুন নেভানো। সে কাজই আমরা করছি। আমার ধারণায় আমি মনে করি এটাই সংগত সঠিক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন