বিইআরসির বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না এলপি গ্যাস

আবু তাহের

দেশে রান্নার কাজে ব্যবহূত গ্যাসের দাম স্থিতিশীল রাখতে খুচরা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ের ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ধরা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। ১২ এপ্রিল থেকে দেশের সব বাজারে দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু দাম নির্ধারণের পর দশদিনের বে‌শি সময় পেরিয়ে গেলেও রাজধানীসহ বেশির ভাগ শহরে আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে সিলিন্ডার। এতে গ্রাহক পর্যায়ে যেমন অসন্তোষ বাড়ছে, তেমনি এলপি গ্যাসের খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারাও পড়ছেন বিড়ম্বনায়।

কয়েকজন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রেতারা সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাস কিনতে চাইছেন। কিন্তু পরিবেশক বা ডিলার কারো কাছ থেকেই খুচরা বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে গ্যাস কিনতে পারছেন না। ফলে ক্রেতাদের কাছেও কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলেছিল, এলপি গ্যাসের দাম বিষয়ক আদেশ বাস্তবায়ন না হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত তার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

অবশ্য বিইআরসির দাবি, তাদের আদেশের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম দামে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। দেশের ২৯টি স্থানে কম দামে এলপি গ্যাস বিক্রির কথাও জানায় তারা।

কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মকবুল -ইলাহি চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, বিইআরসির  আদেশের পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। আমাদের কাছে সে তথ্য আছে। রাজধানীতে বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। তবে আমরা বিক্রেতাদের বিষয়টি বুঝিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটির চেষ্টা করছি।

১২ এপ্রিল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে খুচরা পর্যায়ে এলপি গ্যাসের বিভিন্ন সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে দেয় কমিশন। সেখানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ১২ কেজির সিলিন্ডার ৯৭৫ টাকা সরকারি সাড়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ঠিক করা হয় ৫৯১ টাকা। বলা হয়, দাম ঘোষণার দিন থেকেই আদেশ কার্যকর হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে আদেশের তোয়াক্কা করেনি বেসরকারি এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বরং গ্যাসের দাম আগে যা ছিল, এখনো সে দামেই বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

আবার কমিশনের ঠিক করে দেয়া দাম নিয়ে অপারেটরদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তারা বলছেন, কমিশন দাম নির্ধারণের সময় অনেক খরচ বিবেচনায় নেয়নি। ফলে সরকারের দেয়া আদেশ নিয়ে কমিশন এলপি গ্যাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার এখনো হাজার ৫০ থেকে হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিভেদে কোথাও কোথাও সিলিন্ডার হাজার ২০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর রামপুরা, মধ্য বাড্ডা, মিরপুর, শ্যামলী, মগবাজার এলাকায় খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আগের দামেই সিলিন্ডার বিক্রি করছেন। কারণ কোম্পানি বা পরিবেশক পর্যায় থেকে কোনো ঘোষণা তারা পাননি। এসব স্থানে বসুন্ধরা ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে হাজার ৮০ থেকে হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত। টোটাল গ্যাস বিক্রি হচ্ছে হাজার ১০০, ওমেরা সেনা হাজার ৫০, জি-গ্যাস, ফ্রেশ যমুনা হাজার ৫০, বেক্সিমকো হাজার ৬০ পেট্রোম্যাক্স বিক্রি হচ্ছে হাজার ৮০ টাকায়। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানির গ্যাস হাজার ৫০ থেকে হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর রামপুরার উলন রোডের খুচরা এলপি গ্যাস বিক্রেতা আবুল আহাদ বলেন, ডিলারদের থেকে ৫০ টাকা বেশিতে বিক্রি করছেন তারা। দাম আগের মতোই আছে। একই কথা বলছেন স্থানীয় ডিলার পরিবেশকরা।

এদিকে দাম বেঁধে দেয়ার পরও সে অনুযায়ী বাজারে বিক্রি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা। তারা বলছেন, আগের দামেই বাজার থেকে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। দাম কমেনি বরং বেড়েছে। তাহলে দাম নির্ধারণ করে কী লাভ হলো, সে প্রশ্নও রাখেন কেউ কেউ।

রাজধানী মিরপুর- এলাকার চা বিক্রেতা সিকান্দার মিয়া জানান, ১৫ এপ্রিল তিনি বসুন্ধরা এলপি গ্যাস কিনেছেন হাজার ৮০ টাকা দিয়ে। গত মাসেও একই দামে কিনেছিলেন। কমিশনের দাম কমানোর বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, দোকানদার তো দাম কম নেয়নি, আগের দামই রেখেছে।

বিইআরসির দাম ঘোষণার আগে মার্চেও দামে খুচরা পর্যায়ে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে সৌদি আরামকো মূল্য (সিপি) খুব বেশি ওঠানামা না হওয়ায় দেশীয় বাজারেও আগের দামের সঙ্গে খুব বেশি তারতম্য হয়নি।

কমিশনের দাম ঘোষণার পরও আগের দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করার বিষয়ে জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল বণিক বার্তাকে বলেন, কমিশন দাম ঘোষণার পর বাজারে কাছাকাছি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। মাসে কোনো সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে পরবর্তী মাসে। কারণ কমিশন মার্চের সিপি ধরে দাম ঘোষণা করেছে।

এদিকে এলপিজির দাম নির্ধারণে সব ধরনের খরচ বিবেচনায় নিয়ে দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সংগঠনটির একটি সূত্র বলছে, বেসরকারি এলপিজির বর্তমান দামের সঙ্গে আরো ২৮৭ টাকা যোগ করে দাম ঠিক করতে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোয়াবের এক সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা চিঠি দিয়ে আমাদের সংকটের জায়গাগুলো কমিশনকে জানিয়েছি। কমিশন আমাদের সংগঠন থেকে একটি প্রতিনিধি দল চেয়েছে। আমরা প্রতিনিধি দল দিয়েছি। এখন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।

প্রসঙ্গত, দেশের বাজারে এলপি গ্যাসের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংগঠন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) হাইকোর্টে রিট করে। সেই রিটের ওপর হাইকোর্ট শুনানি করে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করার আদেশ দেন বিইআরসিকে। বিইআরসি হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি এক গণশুনানির আয়োজন করে। গণশুনানির পর বিইআরসি ব্যবসায়ী ভোক্তাসংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে ১২ এপ্রিল এলপি গ্যাসের দাম বেঁধে দেয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন