গত
১৪ মাসে করোনা অতিমারিতে সারা বিশ্ব এক অভাবনীয় সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়, চাকরিচ্যুতি, কর্মহীনতা, ক্ষুধা, মানসিক বিষাদ যেন জীবনেরই এক অচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে সারা পৃথিবীতে ১৪০ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত্যুর হার মোটামুটি কম থাকলেও ইদানীং এর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সর্বস্তরের জনগণ আরো বেশি সচেতন না হলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে মৃত্যুর হার আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই আরো অনেক গুণ বেড়ে যাবে বলেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন।
এই বিপর্যস্ত সময়ের মধ্যেই এ বছর পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো করোনা পরিস্থিতিতে ধরিত্রী নিয়ে কেমন চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার অভিপ্রায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গত বছরের মার্চের শেষের দিকে শুরু করে এপ্রিল মাসব্যাপী সামাজিক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে লকডাউন আরোপ করে। লকডাউনের সময়কালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভ্রমণ এবং শিল্প-কারখানার উৎপাদনে শিথিলতা নেমে আসে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোও এ লকডাউনের আওতায় আসে। লকডাউনের সময়কালে বিমান চলাচল অনেকাংশেই কমে আসে এবং নৌ ও সড়কপথেও মোটরচালিত যানবাহনে চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া রাস্তাঘাট-বাড়িঘর নির্মাণ এবং শিল্পোৎপাদনে মন্দা অবস্থা বিরাজ করে। এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পাওয়ার কারণে প্রকৃতি যেন অনেকটাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বায়ুদূষণের মাত্রা লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গাছ, লতা, গুল্ম এবং বনাঞ্চলে সবুজের সমারোহ লক্ষ করা যায়। প্রাণিকুলও তাদের বন-জঙ্গলে সংকুচিত হয়ে পড়া আবাসস্থল ছেড়ে রাস্তাঘাট ও লোকালয়ে চলাফেরা করা শুরু করে। ধুসর আকাশ নীলরূপে নিজেকে মেলে ধরে। বায়ুদূষণের মাত্রা কম হওয়ার কারণে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনেও স্বস্তি নেমে আসে।
করোনাকালীন লকডাউনের কারণে বায়ু মানের উন্নতি যেন শাপে বর হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনাসহ অন্যান্য বায়ুবাহিত জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও বেড়ে যায়, কারণ দূষিত বায়ুর একটি বড় উপাদান হলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা, যার মাধ্যমে যেকোনো বায়ুবাহিত রোগজীবাণু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে। বায়ুদূষণের অন্যান্য উপাদান হলো নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ওজোন গ্যাস। বায়ুদূষণের সব উপাদানই মূলত যানবাহন, ইটভাটা, রাস্তাঘাট-বাড়িঘর নির্মাণ ও শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। করোনা সময়কালে এসব কর্মকাণ্ড কমে আসার ফলে বায়ুদূষণ ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্রা যে কমে আসবে এবং বায়ুদূষণও কমে আসবে—এ ধারণা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উপাত্ত সংগ্রহে মনোনিবেশ করে, যাদের মধ্যে জাতিসংঘ, নাসা এবং বিভিন্ন গবেষণাগার অন্যতম। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্টের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনাকালীন লকডাউনের সময়ে শিল্পোন্নত যেসব দেশ সারা পৃথিবীর ৯০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড উদিগরণ করে, তাদের বিমান চলাচল, সড়ক পরিবহন এবং শিল্পোৎপাদন যথাক্রমে ৭৫ শতাংশ, ৫০ শতাংশ এবং ৩৫ শতাংশ কমে যায়, যার ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৮ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশ কমে যায়। কোনো কোনো দেশে এর মাত্রা ২৭ শতাংশ কমে যায়। এ সময়ে মোটরচালিত যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত এবং শিল্প-কারখানা থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাসসহ অন্যান্য বায়ুদূষণের উপাদান সবচেয়ে কমে যায়।
করোনাকালীন লকডাউনের কারণে গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের চারটি বড় শহরের (ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি ও লাহোর) বায়ুদূষণের মাত্রায় কী পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে এ প্রবন্ধের লেখক একটি গবেষণা করে। ওই গবেষণার জন্য উল্লিখিত চারটি শহরে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটে সংগৃহীত বায়ু মানের বিভিন্ন উপাদানের ঐতিহাসিক রেকর্ড পর্যালোচনা করা হয়। এ গবেষণায় ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসের বায়ুদূষণের পরিমাণ করোনাপূর্ব ২০১৯ সালের এপ্রিলের বায়ুদূষণের পরিমাণের সঙ্গে ঘণ্টামাফিকভাবে তুলনা করা হয়। রেফারেন্স হিসেবে একই সময়কালের নিউইয়র্ক শহরের বায়ুদূষণের সূচকেরও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। এ গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের সূচকের গড় ১৪৩ থেকে কমে ১২০ হয় এবং ২০২০ সালের এই দুই মাসের ৬৮ শতাংশ সময় বায়ুদূষণের মাত্রা ২০১৯-এর একই সময়ের চেয়ে ভালো ছিল। তুলনামূলকভাবে একই সময়কালে কলকাতার বায়ুমানের সূচকের গড় ৯৮ থেকে ৭১-এ নেমে এসেছিল, বায়ুমানের ২৭ শতাংশ উন্নতি হয়েছিল এবং ৭৩ শতাংশ সময় আগের বছরের তুলনায় উত্কৃষ্ট ছিল। অন্যদিকে দিল্লির তুলনায় লাহোরের বায়ু মানের সূচকে সামান্য বেশি উন্নতি হয়েছিল। দিল্লি ও লাহোরের বায়ু মানের সূচকের গড় যথাক্রমে ১৫৭ থেকে ১১৫ (২৬% উন্নতি) এবং ১৮১ থেকে ১৩১ (২৭% উন্নতি)। এ দুই শহরেরই বায়ু মানের উন্নতি হয়েছিল ৭৩ শতাংশ সময়কাল ধরে। এখানে উল্লেখ্য যে বায়ু মানের সূচক শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে হলে ভালো, ৫১ থেকে ১০০ হলে মোটামুটি, ১০১ থেকে ১৫০ হলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০০ থেকে বেশি হলে মারাত্মক হিসেবে পরিগণিত হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসের লকডাউনকালীনও ঢাকা শহরের বায়ুমানের সূচক অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে কিছুটা উন্নতি হলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায়ই রয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের চারটি শহরের তুলনামূলক বিচারে বায়ু মানের সূচকে কলকাতা শহর লকডাউনের আগে এবং পরে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট ছিল এবং ঢাকা শহরের বায়ুমান নিকৃষ্ট ছিল। অন্যদিকে নিউইয়র্ক শহরে যানবাহন এবং শিল্প-কারখানার পরিমাণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে উপমহাদেশের চারটি বড় শহরের যৌথ পরিমাণের চেয়ে বেশি হলেও করোনাপূর্ব ও করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও বায়ু মানের সূচক যথাক্রমে ২৫ এবং ২১ ছিল, যা কিনা খুবই ভালো। নিউইয়র্কের বায়ুমান সূচকের বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সেখানকার যানবাহন ও শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বায়ু মান সবসময়ই স্বাস্থ্যকর মাত্রায় রাখার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, করোনাকালীন লকডাউনের সময়ে বাধ্য হয়ে যানবাহন চলাচল ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে যদিও বায়ু মানের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, সেই অবস্থা স্থায়ীভাবে উন্নতি করার উপায় কী? নিউইয়র্ক শহরের উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে যানবাহন ও শিল্প-কারখানার পরিমাণের ওপর বায়ু মানের সূচক নির্ভর করে না। ভালো মানের যানবাহন ও উন্নত মানের জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যকর মাত্রায় রাখা সম্ভব। তাছাড়া সঠিক নীতিমালা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেও বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। কলকাতা শহরের যানবাহন, শিল্প-কারখানা এবং আশেপাশের ইটভাটার পরিমাণও অনেকটা ঢাকা শহরের সমমানের। কিন্তু কলকাতা শহরের বায়ু মানের সূচক করোনাপূর্ব এবং করোকালীন লকডাউনের সময়ে ঢাকা শহরের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। কলকাতা শহরে যেখানে মোট ১১টি বড় পাবলিক পার্ক রয়েছে, সেখানে ঢাকা শহরের পার্কগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। কলকাতার নিউ টাউনকে যেখানে অফিশিয়ালি সবুজ শহর ধরা হয়, সেখানে ঢাকা শহরে সবুজের পরিমাণ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে সবুজ আচ্ছাদনে ঘেরা জায়গার পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ, যা কিনা পৃথিবীর বড় শহরগুলোর তুলনায় অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে নিউইয়র্কের সবুজ গাছগাছালির পরিমাণ ২৭ শতাংশ।
করোনাকালীন লকডাউনে বাধ্য হয়ে হলেও ঢাকা শহরের বায়ু মানের সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। সেই সূত্র ধরে এবং উপমহাদেশের অন্যান্য বড় শহরের সঙ্গে তুলনা করে এটি প্রতীয়মান হয় যে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ স্থায়ীভাবে কমিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর শহরে পরিণত করা সম্ভব। ভৌতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বায়ু, জল, প্রাণ-প্রকৃতির উন্নয়নে ব্রতী হয়ে একটি আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত তিলোত্তমা নগরী গড়ার কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারকরা কাজ করবেন, এটাই হোক এ বছরের ধরিত্রী দিবসের স্বপ্ন।
ড.
মো. খালেকুজ্জামান:
অধ্যাপক
লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র