নতুন দরিদ্র এখন ২ কোটি ৪৫ লাখ

সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করতে হবে

গত দুই দশকে দেশে দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। তবে করোনাকালে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতিতে আগের সাফল্য কিছুটা ম্লান। নতুন করে দরিদ্রের সারিতে যোগ হচ্ছে বিপুল মানুষ। পিপিআরসি বিআইজিডির সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপের তথ্য বলছে, করোনার এক বছরে দেশের ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে; সংখ্যায় তা কোটি ৪৫ লাখ। করোনার আগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে সাড়ে তিন কোটিতে নেমে এসেছিল। গবেষণা সংস্থা দুটির প্রাক্কলন বিবেচনায় নিলে এখন দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ মোকাবেলায় দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। শিল্প-কারখানা খোলা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট বন্ধ। এতে অর্থনীতি, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধস দৃশ্যমান। অবস্থায় মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কায় দারিদ্র্য হার আরো বাড়ার আশঙ্কা। এতসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যের কোটায় অন্তর্ভুক্তি দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে বৈকি।

করোনাকালে দারিদ্র্য হার দ্রুত বাড়ার প্রধান কারণ মানুষের কর্মহীনতা আয় কমে আসা। গত বছর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রায়ই আড়াই মাস সাধারণ ছুটি তথা অঘোষিত লকডাউন আরোপ করা হয়। ওই সময় কৃষি খাতে শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ সামাজিক দূরত্ব মেনে বিপণন ছাড়া অন্য প্রায় সব খাতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুরিজমসহ বন্ধ হয়ে পড়ে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা সেবা খাত। বন্ধ হয়ে যায় কাঁচাবাজার, ওষুধ নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকান-মার্কেট। এর অভিঘাত পড়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী কর্ম হারিয়েছে। পরে সবকিছু খুলে দেয়া হলেও অনেকেই আর কাজে ফিরতে পারেনি। আবার বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে অনেকের বাড়েনি আয়। ফলে তাদের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। চলমান লকডাউনেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় শ্রমজীবীদের বিপুলাংশেরই কাজ নেই। এতে দারিদ্র্য যে আরো বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। অবস্থায় যথাযথভাবে তালিকা তৈরিপূর্বক দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদার জরুরি।

করোনাসৃষ্ট নতুন দারিদ্র্যের অঞ্চলগত মাত্রাটি খুব সুস্পষ্ট। করোনার আঘাত সব জায়গায় একইভাবে অনুভূত হয়নি। শহরের তুলনায় গ্রামে তার প্রভাব কমই দেখা গেছে। কারণে শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত। জরিপের তথ্য বলছে, শহরের বস্তিবাসী নভেল করোনাভাইরাসের আগে যে আয় করত, এখনো সে অবস্থায় ফিরতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম আয় হচ্ছে তাদের। সংগত কারণে তাদের জীবনমান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।  বাস্তবতায় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের পুনর্বিন্যাস করার সময় এসেছে। দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বরাদ্দ যেমন বেশি, তেমনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও অনেক বেশি সেখানে সক্রিয়। তুলনায় শহরাঞ্চলে তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত। সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে শহরকে অগ্রাধিকার দিলেও অতিদরিদ্রদের সহায়তার বিষয়ে অনেকটা উদাসীন। প্রবণতার পরিবর্তন প্রয়োজন। নগর দারিদ্র্য সার্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে একটি বড় ইস্যু হিসেবে হাজির হয়েছে। একে উপেক্ষার সুযোগ নেই। সেজন্য সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন নীতির অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আনতে হবে। শহরের দারিদ্র্য কমাতে হলে অবিলম্বে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। তাদেরও সনাতনী চিন্তা   গতানুগতিক দারিদ্র্য কৌশল থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশে ধারাবাহিক সাফল্য বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় সমর্থন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার যুগপৎ অবদান রয়েছে। আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল উন্নয়নশীল অনেক দেশেই অনুসরিত হচ্ছে। নিশ্চয়ই করোনাসৃষ্ট দারিদ্র্যও সফলতার সঙ্গে আমরা মোকাবেলা করতে পারব। তবে তার জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বিরাজমান ঘাটতিগুলো দূর করা দরকার। নতুন মাত্রাগুলো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী, সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়াতে হবে নগদ সহায়তা। সরকার এরই মধ্যে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এটা ইতিবাচক। ব্যক্তির এমএফএস হিসাবের মাধ্যমে এটা দেয়ার কথা। এক্ষেত্রে সুফলভোগীর তালিকা তৈরি থেকে বিতরণ সব পর্যায়ে আগের ত্রুটির পুনরাবৃত্তি দূর স্বচ্ছতা আনতে হবে। করোনাকালীন সহায়তার ক্ষেত্রে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে দৃষ্টান্তমূলক। দেশটি একটি হটলাইন নম্বর চালু করেছে। সেখানে সহায়তা প্রয়োজন হওয়া যে কেউ ফোন করতে পারে। ফোন করলে টেলিফোন কর্মীরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করেন এবং অনলাইনে নিবন্ধন করে নেন। এতে তালিকা তৈরি বিতরণ প্রক্রিয়ায় আসে স্বচ্ছতা। আমাদের দেশেও এটা অনুসরণ করা যেতে পারে।

বিপুলসংখ্যক মানুষের দরিদ্রে যোগ হওয়া আমাদের জন্য বেশ উদ্বেগের। অবস্থায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সামাজিক সহায়তা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।  পাশাপাশি বিশেষায়িত কর্মসূচি নিতে হবে। টোকেন কর্মসূচি নয়। নতুন আড়াই কোটি দরিদ্রকে অন্তর্ভুক্ত করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সাজাতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র এসএমই খাতে প্রণোদনা বাস্তবায়নের পন্থায় আনতে হবে পরিবর্তন। করোনা-পরবর্তী শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ। যেসব দেশ রকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাদের পন্থা পর্যালোচনা করতে হবে। মোদ্দাকথা, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের পাশাপাশি অর্থনীতি কর্মসংস্থান উন্নয়নের বিষয়টিও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ভাবনায় রাখা চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন