হিটশক ও শিলাবৃষ্টি

হাইব্রিড ধানবীজ সংকটের শঙ্কা

সাইদ শাহীন

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদ করা হয়। পরিমাণ ধান আবাদের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ১০ হাজার টন ধানবীজ। দেশে হাইব্রিড ধান উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ ধানবীজের প্রয়োজন হয়, তার ৮০ ভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার একর জমিতে ধানবীজের আবাদ করা হয়েছিল। তবে হিটশক শিলাবৃষ্টিতে ৩০ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে আগামী অর্থবছরে ধান আবাদে বীজের সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশে হাইব্রিড বীজ ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। বাড়তি উৎপাদনশীলতার কারণে প্রথম কয়েক বছর আবাদ সম্প্রসারণে ধারাবাহিক সাফল্যও আসে। কয়েক বছর ধরেই দেশে ধানবীজের উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএ) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১১ হাজার ৪৩৯ একর জমিতে হাইব্রিড ধানবীজ আবাদ হয়েছে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবাদ হয়েছিল ১০ হাজার ৭৫৬ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৮৩ একর জমিতে। এক সময়ের পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ধানবীজের মাত্র ২০ শতাংশ এখন আমদানি করতে হয়।

তবে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে হিটশক সম্প্রতি শিলাবৃষ্টিতে বীজক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কেননা ধানগাছ বৃদ্ধির কিছু পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে। যেমন অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে ধানের পাতার অগ্রভাগ সাদা হয়ে যায়, পাতায় ক্লোরোটিক সাদাটে ব্যান্ড বা ব্লচ দেখা যায়। এছাড়া গোছায় কুশির সংখ্যা গাছের উচ্চতা কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। ফলে ধানে চিটা দেখা যায়।

বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক . মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে ফলনে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব না ফেললেও প্রজনন পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা, বিশেষ করে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে ধানের ফলনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ধানের প্রজনন পর্যায়ে শীষ বের হওয়ার নয়দিন আগে তাপমাত্রা ৩৫-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফুল ফোটা পরাগায়নের সময় - ঘণ্টা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হলে সাদা শীষসাদা স্পাইকলেট, শীষে স্পাইকলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া চিটা সমস্যা দেখা দেয়। এবারে সেটি দেখা গেছে। ধানের পরিপক্ব পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা দানা গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে বিধায় অর্ধপুষ্ট দানার সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে ধানের ফলন গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেননা সময়ে ধানের স্বয়ংক্রিয় কুলিং সিস্টেম বাধাগ্রস্ত হয়। এতে ধানে চিটা বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএ) জানিয়েছে, হাইব্রিড বীজের সিংহভাগই সরবরাহ করে থাকে বেসরকারি ২০টির বেশি কোম্পানি। দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে সুপ্রিম সীড, ব্র্যাক, লালতীর, এসিআই লিমিটেড পেট্রোকেম সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া দেশী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আফতাব বহুমুখী ফার্মস, ইস্পাহানি এগ্রো, মল্লিকা সীড, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, সিনজেনটা, ম্যাকডোনাল্ডস, ইউনাইটেড, তিনপাতা কোয়ালিটি সীড, নর্থ সাউথ সীড, ইস্ট ওয়েস্ট সীড, মেটাল সীড, সিদ্দিক সীডস, এনার্জি প্যাক, পারটেক্স সীড, গেটকো এগ্রো ভিশন, অটো ক্রপ কেয়ার, গেটকো। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এক থেকে দুই হাজার টন বীজ উৎপাদন করে।

বিষয়ে সুপ্রিম সিড কোম্পানি লিমিটেডের চেয়্যারম্যান কৃষিবিদ মোহাম্মদ মাসুম বলেন, দেশে গত দুই দশকের ব্যবধানে হাইব্রিড শস্যের আবাদ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। হাইব্রিড বীজের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে ৮০ শতাংশই দেশে উৎপাদন করছে দেশের বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করেই দেশে বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে চলতি বছরে হিটশক নতুনভাবে উদ্বেগে ফেলেছে উৎপাদনকারীদের। চলতি মৌসুমে আড়াই হাজার টন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে আবাদ করলেও সেই লক্ষ্যমাত্রা সম্ভবত পূরণ হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেনবর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগান দিতে হলে নতুন জাত, ভালো বীজ এবং উন্নত প্রযুক্তি দ্রুত মাঠে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে হাইব্রিড ধান অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। তবে বাংলাদেশে এখনো সেটি সম্প্রসারিত হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় হাইব্রিড ধানের আবাদে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশ। জাপানে প্রায় ৯৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড বীজের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন হচ্ছে। চীনে ৭০-৭৫ শতাংশ ধানের জমিতে হাইব্রিড বীজ ব্যবহার হয়। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র বোরো আবাদের ১০-১২ শতাংশ ধানের আবাদ হচ্ছে হাইব্রিড ধানবীজে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছর পর্যন্ত দেশে ২০১টি হাইব্রিড ধানবীজ অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ১৮৬টি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) সাতটি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সাতটি এবং বিএসএমআরএইউর একটি জাত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি জাত অনুমোদন পেয়েছে বোরো ধানের, যার পরিমাণ ১৭০টি এর পরই আমনের ২৫টি আউশের ছয়টি জাত রয়েছে।

জার্মানিভিত্তিক বায়ার ক্রপসায়েন্স বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০০২ সালে। দেড় যুগের ব্যবধানে দেশের হাইব্রিড ধানবীজের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কোম্পানিটি দেশের বাইরে বীজের উৎপাদন করে। ফলে আগামী বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধানবীজের বড় অংশ সরবরাহের নেতৃত্বে থাকতে পারে বায়ার ক্রপ। এছাড়া সিনজেনটাকেও বীজের বাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে হতে পারে। পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে হতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন