চার সাধারণ বীমা কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দর

মেহেদী হাসান রাহাত

পুঁজিবাজারে কোন কোম্পানির শেয়ার কী দরে লেনদেন হবে, সেটি নির্ভর করে কোম্পানির ব্যবসায়িক আর্থিক ফলাফলের ওপর। কোম্পানির ব্যবসা ভালো হলে তার প্রতিফলন ঘটে আর্থিক ফলাফলে এবং বিনিয়োগকারীরাও আকর্ষণীয় লভ্যাংশ পান। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বেশি থাকে, যে কারণে পুঁজিবাজারে সেই শেয়ারের দামও হয় আকর্ষণীয়।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাধারণ বীমা খাতের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কোনো কারণ ছাড়াই গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এবারো এক মাস ধরে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ছে। যদিও কোম্পানিগুলোর আর্থিক কিংবা ব্যবসায়িক পারফরম্যান্সে এমন কোনো বড় প্রভাব পড়েনি, যে কারণে শেয়ারদর বাড়বে। এর মধ্যে চার কোম্পানির শেয়ারদর ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে, যার সঙ্গে কোম্পানির ব্যবসায়িক আর্থিক নির্দেশকের কোনো সামঞ্জস্য নেই। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জের চিঠির জবাবেও কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, তাদের শেয়ারদর বাড়ার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। ফলে দর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সাধারণ বীমা খাতের এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ১০৬ টাকা ২০ পয়সা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ১০৭ টাকা ৭০ পয়সা, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ১১২ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ১৩০ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। কোম্পানির শেয়ারদর নির্ধারণে অন্যতম একটি নির্দেশক হচ্ছে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) সে হিসেবে বর্তমানে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার এনএভিপিএসের পাঁচ গুণেরও বেশি দরে লেনদেন হচ্ছে। আর ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর এনএভিপিএসের আড়াই গুণেরও বেশি।

এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। এর আগের ২০১৯ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানিটির এনএভিপিএস ১৯ টাকা ৫০ পয়সা। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে টাকা ৫৫ পয়সা। আর সময়ে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন। সর্বশেষ ২০২০ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে টাকা ৬৯ পয়সা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল টাকা ৩৮ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ শেষে কোম্পানিটির এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা পয়সা।

জানতে চাইলে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমাম শাহীন বণিক বার্তাকে বলেন, কোম্পানির আর্থিক, ব্যবসায়িক সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমানে যে শেয়ারদর রয়েছে, সেটিকে একেবারে অযৌক্তিক বলে মনে করছি না। তার কারণ আমাদের সম্পদ বছরে ২০০ কোটি টাকার সমান হয়ে যাবে। ব্যাংকে ৯০ কোটি টাকার মতো এফডিআর করা আছে। আমাদের সম্পদ পরিমাণে কম হতে পারে, কিন্তু আমরা প্রকৃত অবস্থাই তুলে ধরেছি। তার ওপর আমাদের পর্ষদের সুনাম রয়েছে, তারা কোম্পানির কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন না। সব মিলিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ২০১৯ হিসাব বছরে এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা পয়সা। সময়ে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে টাকা ৫৫ পয়সা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল টাকা ৩৭ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ শেষে কোম্পানিটির এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ৪০ পয়সা।

ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের এনএভিপিএস ২০১৯ হিসাব বছর শেষে ৪৪ টাকা ৫৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। সময়ে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ১৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে টাকা ৫১ পয়সা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল টাকা ১৫ পয়সা। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকা ৩০ পয়সায়।

প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের এনএভিপিএস সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছর শেষে  ২১ টাকা ১১পয়সায় দাঁড়িয়েছে ।  সময়ে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে কোটি ২০ লাখ টাকা, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল কোটি লাখ টাকা। আর আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৭ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। গতকাল ডিএসইর ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির ১২৭ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।

কোম্পানির ব্যবসায়িক আর্থিক ফলাফলের সঙ্গে বিদ্যমান শেয়ারদর যৌক্তিক কিনা জানতে চাইলে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বীমা খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। আগামী কয়েক বছরে খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে। ২০১৮ সালে আমরা ৪৮ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করেছি, যা ২০১৯ সালে ছিল ৬৭ কোটি টাকা। ২০২০ সাল শেষে তা ৯২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আমাদের শেয়ারের যে দর রয়েছে, সেটিকে আমি অতিমূল্যায়িত বলেই মনে করি। গত কয়েক বছরে আমাদের যে প্রবৃদ্ধির ধারা, তা যদি আরো বছর দুয়েক বজায় থাকে, তাহলে বর্তমানে যে শেয়ারদর রয়েছে, তখন সেটি যৌক্তিক হবে বলে জানান তিনি।

দেশের বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক শেয়ারদরের বিষয়টি গত বছর থেকেই পুঁজিবাজারে বেশ আলোচিত। কোম্পানির ব্যবসায়িক আর্থিক পারফরম্যান্সের তুলনায় অতিমূল্যায়িত শেয়ারদরের পেছনে কারসাজি চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের অতিমূল্যায়িত এসব শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েক ধরনের বিশ্লেষণ করে থাকেন। আবার বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে। কেউ কম ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন, কেউ আবার বেশি রিটার্নের আশায় বেশি ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। সেকেন্ডারি বাজারে চাহিদা জোগানের ভিত্তিতে শেয়ারের দর নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে কমিশনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। তবে কেউ যদি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে শেয়ার দর কারসাজি করে থাকেন, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই কমিশন ব্যবস্থা নেবে। আমরা বরাবরই বিনিয়োগকারীদের জেনে-বুঝে এবং ঝুঁকির বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে থাকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন